ভারতে সয়াবিন রপ্তানির প্রভাবে দাম বাড়ছে পোলট্রি ও গবাদি পশু খাদ্যের

358

ভারতে প্রাণিখাদ্য তৈরির কাঁচামাল সয়াবিনের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে। এতে বাংলাদেশে আগে থেকেই ঘাটতি থাকা সয়াবিনে বেশ সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট পরিস্থিতিতে ফের বাড়ছে খাদ্যের দাম। এমনই জানিয়েছেন দেশের পোলট্রি ও গবাদি পশুর খাদ্য প্রস্তুতকারী কারখানাগুলো। আজ রোববার থেকে তাদের তৈরি খাবারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ‘আমরা ফিডের দাম ততটুকুই বাড়াব যতটুকু না বাড়ালে হয় না। ইতিমধ্যে ৩০ শতাংশের ওপরে ফিড তৈরির পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু আমরা সে অনুযায়ী ফিডের দাম বাড়াইনি। আমরা কম দামে ডিম ও মাংস জনগণকে দিতে চাই। তার জন্য সয়াবিনসহ অন্য পণ্যের দাম সহনশীল মাত্রায় থাকতে হবে, নিজেদের সংকটে রেখে ভারতসহ যে কোনো দেশে সয়াবিন রপ্তানি বন্ধ না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’

তিনি আরো বলেন ‘সারা দুনিয়াতে সয়াবিন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমরা সয়াবিনের বড় অংশ উৎপাদন করি, সেখানে আমরা কোনোভাবেই রপ্তানি করতে পারি না। এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। দ্রুত এই সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে ডিম, দুধ, মাছ, মাংসের দাম বেড়ে যাবে। ফলে জনস্বাস্থ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

জানা গেছে,ভারতের উদ্ভুত সংকট মেটাতে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি করলে তা দেশটিতে পৌঁছাতে সময় লাগবে অন্তত ৬০ দিন। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের পোলট্রি মুরগি ও গবাদি পশুর খাবার তৈরির ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ থেকে সয়াবিন মিল বা সয়াবিনের খইল আমদানির দাবি জানায় দেশটির ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সয়াবিন মিল রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। রপ্তানির কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় বাজারে সয়াবিনের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা।

সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ডিম, মাছ, মুরগি উৎপাদনে মোট খরচের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ খরচই হয় ফিড কেনা বাবদ। ফিডের দাম বৃদ্ধি পেলে খামারিদের উৎপাদন খরচ বাড়ে। আবার খরচের বিপরীতে পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় বড় অংকের লোকসানের মুখে পড়তে হয় উদ্যেক্তাদের। দফায় দফায় খাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে লোকসানের মুখে আছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। নিজের দেশে সয়াবিন ঘাটতি থাকা স্বত্ত্বেও ভারতে সয়াবিন রপ্তানির কোন মানে হয়না। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার মুরগি, মাছ ও পশু খাদ্যের জন্য বিদেশ থেকে আনা সয়াবিনের ওপর কোনো শুল্ক রাখেনি। বিনা শুল্কে বিদেশ থেকে সয়াবিন এনে তা ফের ভারতে বিক্রি করা হলে বড় আকারে শুল্কও ফাঁকি দেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট খাতের তথ্য অনুযায়ী দাম বাড়তে থাকলে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম আর গরিবের নাগালে থাকবে না। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও ফিড মিলিয়ে এই খাতে বছরে ২ লাখ কোটি টাকার বাজার রয়েছে। এই খাতের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ এখনো দেশীয় কোম্পানির হাতে রয়েছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের দাপট থাকায় মাত্র সাত থেকে আট টাকায় একটি ডিম পাওয়া যেত দেশে। আর ১৪০ টাকায় মিলত এক কেজি পোলট্রি মুরগির মাংস। কিন্তু গত কয়েক দিনে ডিমের দাম বেড়ে পিসপ্রতি ১১টাকা এবং পোলট্রি মুরগির মাংস কেজিপ্রতি ১৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের প্রোটিন ও আমিষের সব থেকে বড় জোগান এই দুটি খাদ্য থেকেই আসে।

দেশি উদ্যোক্তারা বলছেন, ক্রমাগত লোকসান শুরু হলে এই খাতের বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো টিকে যাবে। কারণ তাদের লোকসান সহ্য করে টিকে থাকার মতো আর্থিক সংগতি রয়েছে, যা দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর নেই। ফলে দুই লাখ কোটি টাকার বাজার বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাবে। দেশীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতে সয়াবিন রপ্তানির খবরে ইতিমধ্যে সয়াবিনের বাজারে যেন আগুন লেগে গেছে। রপ্তানির অনুমোদনের আগে দেশে প্রতি কেজি সয়াবিনের দাম ছিল ৪৩ টাকা। সেটি বেড়ে বর্তমানে ৫৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এতে কেজিপ্রতি শুধু পোলট্রি মুরগির খাবারের দাম বেড়েছে আড়াই টাকার বেশি। গত রবিবার থেকে বাড়তি দামে মুরগি, গবাদি পশু ও মাছের খাবার কিনতে হচ্ছে। যার ফলাফল হিসেবে এই সপ্তাহেই মুরগি, মাছ, মাংস ও দুধের দাম আরও বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলসহ সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যক্তিরা বলছেন, ভারতকে সুবিধা দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের মুরগি, গবাদি পশু ও মৎস্য চাষে যুক্ত উদ্যোক্তরা। বাংলাদেশ প্রয়োজনের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সয়াবিন উৎপাদন করে। বাকিটা ভারত, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়। চলতি বছর ভারতে উৎপাদন কম হওয়ায় দেশটিতে সয়াবিনের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আগামী অক্টোবর মাসের আগে দেশটিতে সয়াবিন ক্ষেত থেকে উঠবে না। আর আমদানি করা হলেও সব মিলিয়ে ভারতে তা পৌঁছাতে সময় লাগবে কম করে হলেও ৬০ দিন। আর আমদানি করলেও সয়াবিনের কেজি পড়বে ৮৮ টাকা। সেখানে ৬০ টাকার নিচে বাংলাদেশ থেকে কিনতে পারবে ভারতের ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইমরান হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সয়াবিনের খইল ভারতে রপ্তানি হবে এমন খবরেই কেজিপ্রতি ১০ টাকা দাম বেড়ে গেছে। আর এখন রপ্তানি শুরু হওয়ায় দাম আরও বাড়বে। তাতে বাংলাদেশে ফিড উৎপাদনে খরচ বাড়বে। কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে গরুর মাংসের দাম। মানুষকে বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হবে গরুর মাংস। সেইসঙ্গে বাড়বে পোলট্রি মুরগি, ডিম, দুধ ও মাছের দাম। আমিষের ঘাটতি মেটানো দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’

হিসাব করে দেখা গেছে, এক কেজি সয়াবিনে ১৮ শতাংশ তেল, ৪ শতাংশ ওয়েস্টেজ (বর্জ্য) ও ৭৮ শতাংশ খইল হয়। ব্যবসায়ীরা বিনা শুল্কে বিদেশ থেকে সয়াবিন আনার সুযোগ পান। খইল বিক্রি হয় দেশের ফিড মিলগুলোতে। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কাঁচামালের দাম ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফিড বানাতে অন্তত ১৬টি কাঁচামালের দরকার পড়ে। এর মধ্যে প্রতি কেজি মাছের (রাবিশ) গুঁড়ার দাম ৩২ টাকা, খুদ চালে ১২.১১ টাকা, ভুট্টায় ১২ টাকা, সয়াবিনের খইলে ১৬.২৫ টাকা ও সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ৫৫.৯০ পয়সা।

ভারতে রপ্তানির ঘোষণায় প্রতি কেজি সয়াবিনের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। একটি পোলট্রি মুরগি লালন-পালনের আয়ুষ্কাল হয় ৩৫ থেকে ৩৭ দিন। এ সময়কালে মুরগিপ্রতি অন্তত তিন কেজি তৈরি খাবার দিতে হয়, সেখান থেকে পাওয়া যায় দেড় কেজি মাংস। এক কেজি খাবার বা ফিডে প্রায় ৩০ শতাংশ সয়াবিনের খইল বা সয়াবিন মিলের দরকার পড়ে। সেক্ষেত্রে প্রতি কেজি মাংস উৎপাদনে ৬.২৫ টাকা প্রকৃত উৎপাদন ব্যয় বাড়লে খুচরা পর্যায়ে তা আরও অনেক বেশি বাড়বে। এতে শুধু প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, অনেক ছোট ছোট ফিড মিল বন্ধ হয়ে যাবে।

কারখানা মালিকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৩০০ ফিডমিল থাকলেও চালু রয়েছে মাত্র ১০০টি। এরমধ্যে দেশীয় ফিডমিলগুলোর বড়রকম লোকসান টানার মতো ক্ষমতা নেই। যদি ফিড উৎপাদনে খরচ বাড়ে তাহলে অনেক ফিডমিল বন্ধ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বিদেশি বহুজাতিক ফিডমিলগুলো টিকে থাকতে পারবে লোকসান দিয়েও। অথচ এ খাতে এখনো দেশীয় ফিডমিলগুলো বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে। এ খাতে ফিড, পোলট্রির মাংস, ডিম, গরুর মাংস ও মাছ মিলিয়ে অন্তত দুই লাখ কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বাজার চলে যাবে বিদেশি কোম্পানির হাতে। দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম একটা বৃহৎ খাত শেষ হয়ে যাবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ফিডমিলগুলোতে ব্যবহৃত কাঁচামালের অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশীয় সয়াবিন ছাড়াও ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশে ‘সয়াবিন খইলের’ চাহিদা বছরে প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৭৫-৮০ ভাগ দেশীয় সয়াবিন তেল উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান থেকে এবং বাকিটা আমদানি করা হয়। দেশে উৎপাদিত সয়াবিন খইলের একমাত্র ক্রেতা হচ্ছে পোলট্রি, মৎস ও গবাদি পশুর ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ খামারিরা।

সূত্র: এগ্রিকেয়ার

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১