১৮ টাকার আলু হাত ঘুরে ৫৫ টাকা!

90

মধ্যবিত্তদের পাত থেকে বহু আগেই হারিয়ে গেছে মাংস-ইলিশ। ডিম-আলু আর বিভিন্ন সবজি খেয়ে জীবন ধারণই কষ্টের। এবার সেই আলু নিয়ে চলছে একের পর এক তেলেসমাতি। কোল্ড স্টোরেজের শেড থেকে ১৮ টাকা কেজি দরে বের হয়ে সেই আলু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। হঠাৎ আলুর দামের এমন উল্লম্ফনে ভোক্তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। ভোক্তারা বলছেন, যাও ডিম আর আলু খেয়ে বেঁচে থাকার একটা অবস্থা ছিল সেটাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩০ টাকার আলু কয়েকদিনের ব্যবধানে ৫৫ টাকা হয়ে গেছে। গতকাল কারওয়ান বাজারে আলু কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী ইমদাদুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আলুর দাম নিয়ে এমন কী হচ্ছে যে কয়েকদিনের মধ্যে দাম এত বেড়ে যাবে? আমরা তো শুনেছি কৃষকের কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ টাকা দিয়ে আলু কেনা হয়, তাহলে সেটা ঢাকা আসতে আসতে বড়জোড় ২৫ থেকে ৩০ টাকা হতে পারে। ৫৫ টাকা কীভাবে হয়? এমনিতেই অন্যান্য সবকিছুর দাম অনেক বেশি, এখন যদি আলুও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়, তাহলে আমরা তো না খেয়ে মরব।’

বাজারের আলু বিক্রেতা শাহিন মিয়া বলেন, ‘আমরা দাম দিয়ে আলু কিনছি, আমরা তো লাভ করেই বেচব। পাইকারি ব্যবসায়ীরা আমাদের থেকে বেশি দাম রাখছেন। দাম বেশি হওয়ার কারণে আমাদের বিক্রি অনেক কমে গেছে। দাম যত কম থাকে আমাদের বিক্রি তত বেশি হয়। বিক্রি বেশি হলে লাভও বেশি হয়। দাম বাড়ছে ঠিকই কিন্তু আমাদের তো লাভ বাড়েনি।

আলুর মজুত নিয়ে সরকারি তথ্যে গরমিলের দাবি

আলুর দাম নিয়ে তেলেসমাতির মধ্যে হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন দিয়েছে অন্য তথ্য। সংগঠনটি দাবি করছে, সরকার আলু মজুতের যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কোল্ড স্টোরেজের ২০ শতাংশ খালি রয়েছে। আর এ কারণে বাড়ছে আলুর দাম। এ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা আলু মজুত করছেন বলেও মনে করে সংগঠনটি।

রোববার কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সম্মেলন কক্ষে আলুর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, মুনাফালোভী একটি চক্র আলু মজুত করে দাম বৃদ্ধি করছে। এখানে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কোনো দায় নেই। তবে কারা সিন্ডিকেট করে আলুর দাম বাড়াচ্ছে সরকার চাইলে সেসব তথ্য আমরা দেব। কোল্ড স্টোরেজ শেড থেকে আলু বের হয় ১৮ টাকা কেজি দরে যা খুচরা বাজারে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তিনি বলেন, পরিবহন, আড়ত ও খুচরা বিক্রেতাদের খরচসহ সব মিলিয়ে এ আলু ভোক্তাপর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩৬ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। আমরা মনে করি, মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে যারা আলু সংরক্ষণ করেছেন তারা মনে করছেন আলুর মজুত কম রয়েছে। এজন্য তারা আলুর দাম বাড়াচ্ছেন। সদস্যদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আলু গত বছরের তুলনায় কম সংরক্ষিত রয়েছে। তবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী যে আলু সংরক্ষিত আছে, তা দিয়ে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ আলুর সরবরাহ থাকবে বাজারে। কারা আলুর দাম বৃদ্ধি করছে, কারা সিন্ডিকেট করে আলু মজুত করছে তাদের তথ্য আমরা বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়েছি। বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। এখন আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। হিমাগার মালিকদের যে একতরফা দোষারোপ করা হচ্ছে, এটা সঠিক নয়। সরকার আলু মজুতের যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়।

তিনি আরও বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা আলু ধীরে ছাড়ছেন; ফলে বাজারে দাম বাড়ছে। কেন দাম বাড়ছেÑসেটা সরকারের সংস্থাগুলোকে আমরা বলেছি। এই দাম কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা সরকারকে ভেবেচিন্তে করতে হবে। মোবাইল কোর্ট বা হয়রানিমূলকভাবে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না বলেও মত দিয়েছেন কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের এই নেতা।

গত জুলাইয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আলুর উৎপাদন ও দাম নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই প্রতিবেদনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ১৫ টাকার আলু ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। সাধারণত কৃষকের হাতে আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে সরবরাহ আসতে থাকে। কিন্তু এই সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এবার আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১০ টাকা ৫০ পয়সা, যেটা সব খরচ মিলে খুচরা বাজারে ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কৃত্রিমভাবে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আলুর দাম বৃদ্ধি করছে, যা এখন ৫০-৫৫ টাকায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এর জন্য অবশ্য হিমাগার মালিকদেরও দায়ী করা হয়েছে। কারণ হিমাগার মালিকরা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত পরিমাণ আলু বাজারে ছাড়ছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, চলতি বছর আলুর উৎপাদন ১ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন। তবে তা চ্যালেঞ্জ করে কোল্ড স্টোরেজ মালিক সমিতি বলে, আলুর উৎপাদন ৮৫ লাখ টনের বেশি নয়। সরকারি সংস্থা ভুল তথ্য দিচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত আলুর দাম বাড়াতেই হিমাগার মালিকরা এখন ভুল তথ্য উপস্থাপন করছেন। এখন হিমাগার মালিকরাই কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি আলু কিনে সংরক্ষণ করে তা সুবিধামতো সময়ে বাজারে ছাড়েন। এবার হিমাগার মালিকদের যোগসাজশে অস্থির হয়ে পড়ছে আলুর বাজার। দ্রুত হিমাগারগুলোয় অভিযান চালিয়ে বাজারে আলু ছাড়ার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

আলু পেঁয়াজ ডিমের দাম নির্ধারণ

ডিমের দামের পাশাপাশি আলু ও পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। আলুর কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা এবং পেঁয়াজের দাম ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভাশেষে সাংবাদিকদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। আলুর দাম হবে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা ভোক্তাপর্যায়ে। আর পেঁয়াজের দাম ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার মাঠে থেকে এটি মনিটরিং করবেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাজারে কোনো কারণ ছাড়াই অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন ন্যায্যদাম কার্যকর করব। নতুন করে টিসিবির কার্ড করা হচ্ছে। আমরা (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়) ৫০ লাখ পরিবারের জন্য কার্ড করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক কোটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। বাকিগুলো শিগগির মানুষ হাতে পেয়ে যাবে। কার্ডের কাজ চলছে। সয়াবিন তেলের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমছে বলেও এ সময় জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।

বাজার তদারকিতে রয়েছে ভোক্তা অধিকার

আলুর দাম নিয়ে কারসাজি ঠেকাতে গত বুধবার থেকে মাঠে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কেউ বেশি দাম রাখলে ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি। সংস্থার পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, ‘সরকার আলুর দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখন থেকে কেউ সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি রাখলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ জন্য ভোক্তা অধিকারের কয়েকটি টিম মাঠে কাজ করছে। দাম বেশি রাখছে এমন কিছু দেখলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সব সময় ভোক্তা অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছে।’