সয়াবিন চাষ পদ্ধতি:
সয়াবিন পৃথিবীর একটি অন্যতম প্রধান ফসল। ফসল হিসেবে সয়াবিন এখনও বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নি। তবে ভোজ্যতেল হিসেবে সয়াবিন তেল খুবই জনপ্রিয়।
সয়াবিনের ব্যবহার:
অধিকাংশ মানুষের ধারণা সয়াবিন থেকে শুধু তেল উৎপাদন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে সয়াবিনের অন্যান্য শস্যের মত উপযোগিতা আছে। তেলের পাশাপাশি সয়াবিন থেকে পরোটা, মসলাযুক্ত সয়া বাদাম বা নাট, সয়া পেঁয়াজু, সিঙ্গারা, সয়াবিন চটপটি, সয়া ময়দা, সয়া শিশুখাদ্য, সয়া ডাল, সয়া হালুয়া, সয়া খিচুরী, সয়া পাতরা, সয়া ভর্তা, সয়াবিন মিশ্রিত মিষ্টি কুমড়ার তরকারি, সয়াবিন মিশ্রিত আলুর তরকারি, সয়াবিন মিশ্রিত শাক, সয়া দুধ, সয়া দই, সয়া ভাঁপা পিঠাসহ বিভিন্ন পদের খাদ্য প্রস্তুত করা যায়।
জাত:
আমাদের দেশে বেশ কয়েক জাতের সয়াবিন রয়েছে। এর মধ্যে ব্রাগ, ডেভিস, সোহাগ, বাংলাদেশ সয়াবিন-৪ (জি-২) এবং বারি সয়াবিন-৫ উল্লেখযোগ্য। এখানে কয়েকটি জাতের বর্ণনা দেওয়া হলঃ
১. সোহাগ (পিবি-১)
গাছের উচ্চতা : ২০ থেকে ২৪ ইঞ্চি
বীজ : মাঝারি
বীজের রং : উজ্জ্বল হলদে
বীজে আমিষের পরিমাণ : ৪০ থেকে ৪৫%
তেলের পরিমাণ : ২১ থেকে ২২%
ফসল সংগ্রহ : ১০০ থেকে ১১০ দিন
একর প্রতি ফলন : ৬০০ থেকে ৮০০ কেজি
২. বাংলাদেশ সয়াবিন-৪ (জি-২)
গাছের উচ্চতা : ২৪ থেকে ২৬ ইঞ্চি
বীজ : আকারে ছোট
বীজের রং : হলদে
ফসল সংগ্রহ : ১২০ থেকে ২২০ দিন
একর প্রতি ফলন : ৬০০ থেকে প্রায় ৯০০ কেজি
সয়াবিন চাষের মাটি
বাংলাদেশে সব ধরনের মাটিতে সয়াবিন চাষ করা যায়। তবে পলি, দো-আঁশ মাটিতে সয়াবিন চাষ ভাল হয়।
স্থান নির্ধারণ:
সেচ দেওয়ার এবং পানি বের হয়ে যাওয়ার সুবিধা আছে এরকম সমতল জমি সয়াবিন চাষের জন্য উপযুক্ত।
জমি প্রস্তুত:
জমি ভালভাবে ৪ থেকে ৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। এরপর আগাছা বাছাই করে বীজ বপন করতে হবে।
বপনের সময় ও পদ্ধতি:
আমাদের দেশে রবি ও খরিফ দুই মৌসুমেই সয়াবিন বপন করা যায়। রবি মৌসুমের পৌষ মাসে বীজ বপন করা ভাল। বর্ষা মৌসুমের শ্রাবণ থেকে মধ্য ভাদ্র সময় হিসেবে বীজ বপনের উপযুক্ত। সয়াবিন সারিতে বা ছিটিয়ে বপন করা যায়। তবে সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব রবি মৌসুমে ১২ ইঞ্চি এবং খরিফ মৌসুমে ১৬ ইঞ্চি রাখতে হয়। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২ থেকে ২.৫ ইঞ্চি রাখতে হয়।
আগাছা দমন:
চারা গজানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর আগাছা দমন করতে হবে। গাছ খুব ঘন থাকলে পাতলা করে দিতে হবে। প্রতি বর্গফুটে রবি মৌসুমে ৫ থেকে ৬টি এবং খরিফ মৌসুমে ৪ থেকে ৫টি গাছ রাখা ভাল।
সেচ:
বীজ বপনের ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে (ফুল ধরার সময়) প্রথম সেচ এবং বীজ বপনের ৫৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে (শুঁটি গঠনের সময়) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে।
সার প্রয়োগ:
ইউরিয়া ২০০ গ্রাম
টি.এস.পি ৫০০ গ্রাম
এম.ও. পি ২৫০ গ্রাম
জিপসাম ৪৫০ গ্রাম প্রতি শতাংশে পরিমাণ জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে
এবং প্রতি একরে-
ইউরিয়া- ২০ কেজি
টি.এস.পি- ৫০ কেজি
এম.ও. পি- ২৫ কেজি
জিপসাম- ৪৫ কেজি
সয়াবিন গাছের পোকামাকড় ও পোকামাকড়ের দমন ব্যবস্থা:
বিছা পোকা:
বিছা পোকা গাছের পাতার সবুজ অংশ খেয়ে পাতা ঝাঁঝরা করে ফেলে। এতে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন কমে যায়।
প্রতিকার:
আক্রান্ত পাতাগুলি সংগ্রহ করে পায়ে বা হাতে নিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে। নিয়মিত জমি দেখাশোনা করতে হবে। বুস্টার/রিপকর্ড/সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি এবং মর্টার ৪৮ ইসি ১ মিলি বা এগফস/ক্লোরোপাইরিফস ২মিলি একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফল ছিদ্রকারী পোকা:
এই পোকার শুককীট প্রথমে পাতার সবুজ অংশ খায়। তারপর কুঁড়ি, ফুল এবং শুঁটি আক্রমণ করে। শুককীটগুলি শুঁটি ছিদ্র করে শুঁটির ভেতরে যেয়ে বীজ খেয়ে ফেলে।
প্রতিকার:
শুককীট দেখা দিলে হাত দিয়ে ধরে পিষে মারতে হবে অথবা কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মারতে হবে। প্রতি গাছে দুই বা তার বেশী শুককীট দেখা দিলে রিপকর্ড ১০ ইসি বা বুস্টার ১০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে এই পোকা দমন করতে হবে।
পাতা মোড়ানো পোকা:
সয়াবিন গাছে কিছু পাতা মোড়ানো পোকা দেখা যায়। এরা পাতার রস খায়।
প্রতিকার:
মোড়ানো পাতাগুলো হাত দিয়ে ছিঁড়ে পা দিয়ে ডলে শেষ করতে হবে। না হলে এরা আবার গাছে ফিরে যেতে পারে।
এছাড়াও অন্যান্য পোকার আক্রমণ হতে পারে। পোকা দেখা মাত্র দ্রুত দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগবালাই ও প্রতিকার:
কান্ড ও গোড়া পচা রোগ:
এটি একটি ছত্রাক জাতীয় রোগ। এর সংক্রমনে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়। আক্রান্ত গাছের কান্ড ও মূলে কালো দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত চারা বা গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা যায়।
প্রতিকার:
মাটির উপরে অবস্হিত ছত্রাককে গভীর চাষের মাধ্যমে নষ্ট করতে হবে। চাষাবাদের এলাকা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ফসলের অবশিষ্ট অংশ এবং আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত গাছের গোড়ার মাটি ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে) দিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার ভিজিয়ে দিতে হবে।
মোজাইক রোগ:
পাতার উপরিভাগে সোনালী বা হলুদ রঙের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছ উচ্চতায় সাধারণত খাটো হয়ে যায়। জাব পোকা এবং কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃষকের মাধ্যমে এই রোগের বিস্তার ঘটে। আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র অন্যান্য গাছের থেকে আলাদা করে তুলে মাটির নীচে পুতে ফেলতে হবে।
প্রতিকার:
বালাই সহনশীল জাতের চাষ করতে হবে। জাব পোকার মাধ্যমে এই রোগের বিস্তার ঘটে বলে প্রাথমিক অবস্হায় আক্রান্ত পাতা ও পাতার ডগার জাব পোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলে দিতে হবে। নিম বীজের দ্রবন (১ কেজি পরিমাণ অর্ধভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে) বা সাবান মেশানো পানি ( প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ গুঁড়া সাবান মেশাতে হবে) স্প্রে করেও এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়। প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি ন্যাকফেন ২০ ইসি বা ফেনডিথিয়ন ২০ ইসি বা স্টার্টার/পারফেকথিয়ন ৪০ ইসি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহের সময়:
সয়াবিন গাছ হলুদ হয়ে পাতা ঝরে যাবার পর গাছ কেটে এনে বাছাই করে ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
কম দামে অধিক পুষ্টি পেতে আমরা সয়াবিনের চাষ করতে পারি। অনেকটা মেটাতে পারি আমাদের দেশের পুষ্টির চাহিদা।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৬জুন২০