অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দিতে পারে পাটজাতীয় ফসল ‘মেস্তা’

459

মেস্তা
রংপুর থেকে: দেখতে পাটের মতোই। নাম তার মেস্তা। এই মেস্তা থেকে তৈরি চা, মেস্তা স্বত্ব, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার বাজারজাত করা গেলে দেশের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাবে মনে করছে রংপুর পাট গবেষণা কেন্দ্র।

মনে করা হচ্ছে, পাট জাতীয় এই ফসলটি বাজারজাতকরণে শিল্প উদ্যোক্তারা এগিয়ে না আসায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্ভাবনা গবেষণাতেই আটকে আছে।

রংপুর পাট গবেষণা কেন্দ্র’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবুল ফজল মোল্লা জানান, মেস্তা উপগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এর জনপ্রিয় নাম চুকুর। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে ফলটি পরিচিত। চুকুর পাতা রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। এর মাংসল বৃতি (শাঁস) থেকে চা, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ইত্যাদি তৈরি করা যায়। চুকুরের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান রয়েছে।

তিনি জানান, মেস্তা অর্থাৎ চুকুর পাতার চা হৃদরোগে উপকারি, রক্তের কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া এর পাতায় রয়েছে ক্যানসার প্রতিষেধক উপাদান। এত গুণ থাকার পরেও এর ব্যবহার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না কেউই।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুর পাট গবেষণা কেন্দ্রে চাসহ বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুত করে শুধু প্রদর্শণী ও অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। কোন শিল্প উদ্যোক্তা  এগিয়ে না আসায় এটি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা।

জানা গেছে, সবজি মেস্তার ইংরেজি নাম রোসেলা বা সরেল। এর পাতা ও ফলের মাংসল বৃতি (শাঁস) টক এবং সুস্বাদু। পৃথিবীর অনেক দেশেই সবজি মেস্তার বাণিজ্যিক চাষ করা হয় এবং খাদ্য হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। রংপুর ও রাজশাহীতে চুকাই, খুলনায় ও সাতক্ষীরায় অম্লমধু, ধামরাই এবং মানিকগঞ্জে চুকুল, সিলেটে হইলফা, কুমিল্লায় মেডশ, চাকমারা বলেন আমিলা, মগরা চেনেন পুং ও ত্রিপুরারা উতমুখরই নামে এ ফসল পরিচিত। আবার কেউ কেউ বলেন হুগ্নিমুখুই। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একে বলা হয় খড়গুলা। সব শব্দের সরল বাংলা অর্থ টক।

ড. মো. আবুল ফজল মোল্লা আরো বলেন, মেস্তা বেশ খরা সহিষ্ণু এবং পাটের তুলনায় কম উর্বর জমি যেমন- চরাঞ্চল ও পতিত জমিতে স্বল্প খরচে এর চাষ করা যায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বন্য প্রজাতির মেস্তা (এম-৭১৫) থেকে বিশুদ্ধ সারি নিবার্চন ও গবেষণার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল সবজি হিসেবে খাবার উপযোগী একটি উন্নত মেস্তার জাত উদ্ভাবন করেছে এবং জাতীয় বীজ বোডর্ কতৃর্ক ২০১০ সালে বিজেআরআই মেস্তা-২ (সবজি মেস্তা-১) নামে অবমুক্ত করা হয়েছে। এর কাণ্ড তামাটে রঙের এবং শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট। কাণ্ড ও পাতায় কোনো কাঁটা থাকে না। পাতা আঙ্গুল আকৃতির (খণ্ডিত), পাতার কিনারা ঢেউ খেলানো, গাঢ় সবুজ এবং পরিণত অবস্থায় তামাটে লাল রং ধারণ করে। পাতার বৃন্ত ১০-১১ সেমি। ১৩০-১৪০ দিনে গাছে ফুল আসে। ফুলের ব্যাস ৫-৭ মিমি, দল হলদে, গোড়ায় মেরুন দাগ রয়েছে। চুকুরের একটি গাছে ৪০-৬০টি ফল ধরে। ফল অপ্রকৃত, ক্যাপসুল আকৃতির, ওপরের দিকে চোখা ও রোমমুক্ত এবং বৃতি পুরু ও মাংসালো।

প্রতি হেক্টর জমিতে ৭ হাজার ৭৮৯ কেজি সবুজ পাতা এবং ২০০০-২০৫৫ কেজি বৃতি উৎপাদন হয়। বীজ গাঢ় বাদামী, রেমিফর্ম ও কিডনি আকারের। চুকুরের ১০০০টি বীজের ওজন প্রায় ২০ গ্রাম। এর খৈল গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বীজ থেকে ২০শতাংশ খাবার তৈল উৎপাদন হয়। মেস্তার তেলে ১৫.৮% পালসিটিক এসিড, ৬.৮% স্টিয়ারিক এসিড, ৫১% অলিক অ্যাসিড ও ২৬.৮ লিনোলিক এসিড থাকে। মেস্তার তৈল পৃথিবীর অনেক দেশে সাবান তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এবং খাবার তেলে মেশানো হয়।

পাটের চেয়ে সবজি মেস্তার বীজ বড় হওয়ায় জমি চাষ করার সময় মাটি তত মিহি না করলেও চলে। তবে এর শিকড় মাটির বেশ গভীর থেকেও খাদ্যরস সংগ্রহ করে, তাই জমি গভীর করে চাষ দেয়া ভালো। জমির প্রকারভেদে আড়াআড়িভাবে দুই-তিনবার চাষ ও মই দিতে হবে। আগাছা বাছাই করে ফেলতে হবে। সবজি মেস্তা বৈশাখের প্রথম থেকে শ্রাবণের শেষ পযন্ত সময় বপন করা যায়। ছিটিয়ে বপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে ১২-১৪ কেজি এবং সারিতে বপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে ১০-১২ কেজি পরিমাণ বীজ প্রয়োজন হয়। ফুল আসার পরে উপযুক্ত সময়ে ফল পরিপুষ্ট হলে হাত দিয়ে ফল ছিঁড়ে অথবা মাংসল বৃতি (শাঁস) সংগ্রহ করতে হয়।

রংপুর পাট গবেষণা কেন্দ্রর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরো জানান, এত গুণের এই ফসলটি বাণিজ্যিভাবে চাষাবাদ শুরু করা গেলে খুব অল্প সময়ে পাল্টে যাবে দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির চিত্র। সূত্র: এনটিএন