অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার

1211

নিত্যপণ্য

পেঁয়াজ সহ চাল, আটা, ময়দা ও তেলসহ প্রতিটি ভোগ্যপণ্যই সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টর। পেঁয়াজ নিয়ে হুলুস্থুল কান্ডের মধ্যেই গত এক সপ্তাহ আগে বাজারে চিকন-মোটা সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে পালস্না দিয়ে ময়দার বাজারও এখন লাগামহীন। মাছ-মাংস-সবজির দরও কদিন ধরে তরতর করে ওপরের দিকে চড়ছে। খোলা সয়াবিন তেলের দামও বেড়েছে ড্রামপ্রতি দুই হাজার টাকা। সব মিলিয়ে বাজার বেসামাল হয়ে উঠেছে। অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা এখনো নাজুক। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে শুধুমাত্র মিডিয়াতে প্রচার-প্রোপাগান্ডা করে চুপ।

বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকলেও তারাও বরাবর এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়। শুধুমাত্র আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির পর দেশে হুলুস্থুল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তারা নড়েচড়ে বসে। তবে সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে তাদের এ ভূমিকা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো কাজে আসছে না। বরং তাদের এ বিলম্বিত তৎপরতার কারণে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেট বাজার পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করে তোলার সুযোগ পাচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, পেঁয়াজের বাজার দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল থাকলেও মাত্র কদিন আগে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এ ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে তারা ৪৬ জন আমদানিকারকের তালিকা তৈরি করে পর্যায়ক্রমে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব আমদানিকারক পেঁয়াজ আমদানির মধ্য দিয়ে বিদেশে অর্থপাচার এবং অতিমুনাফা করেছেন কি না তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে। অথচ পেঁয়াজের আকাশচুম্বী দরের কারণে এরই মধ্যে ভোক্তাদের পকেট থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ বেরিয়ে গেছে। শুরুতেই এ ব্যাপারে শুল্ক গোয়েন্দারা তৎপর হলে পেঁয়াজ আমদানিকারক সিন্ডিকেটের লুটপাট বন্ধ করা যেত বলে মনে করেন ব্যবসায়ী নেতারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পেঁয়াজের সঙ্গে পালস্না দিয়ে সম্প্রতি যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, এর কোনোটিরই তেমন ঘাটতি নেই। দেশে পর্যাপ্ত উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশ থেকে এসব পণ্য এরই মধ্যে আমদানি করা হয়েছে। অথচ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার সিন্ডিকেট এসব পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।

আকস্মিক চালের দর বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই বলে আড়তদার, মিল মালিক ও খুচরা বিক্রেতারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন। খাদ্য অধিদপ্তরও গুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুত থাকার কথা জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাবি, সিন্ডিকেটের কারসাজি ছাড়া এ সময় চালের দাম বাড়ারও কোনো কারণ তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। অথচ বাজারে এখন যে দামে চাল বিক্রি হচ্ছে সেটি বছরের এ সময়ে সাধারণত যে দামে চাল বিক্রি হয় তার চেয়ে কেজি প্রতি গড়ে চার-পাঁচ টাকা করে বেশি।

চালের বাজার তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা জানান, সারা দেশে ৭ সিন্ডিকেট চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের মধ্যে আমদানিকারকদের ২টি, চালকল মালিকদের ৪টি ও মজুতদারদের ১টি সিন্ডিকেট রয়েছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার ৪৮ চালকল মালিকের সিন্ডিকেট সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। গত কয়েক দিনের ব্যবধানে কুষ্টিয়া মোকামে সব ধরনের চালে তারা কেজিপ্রতি এক টাকা বাড়িয়েছে। আড়তে চাল সংকট দেখিয়ে ওই সিন্ডিকেট চালের দাম বাড়ালেও কুষ্টিয়া মোকামে গত এক সপ্তাহে ১০ হাজার মেট্রিক টন চাল মজুত আছে বলে জেলা প্রশাসনের কাছে তথ্য রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ধানের দাম বৃদ্ধি ও মোকামে চাল সংকটের অজুহাতে কুষ্টিয়া মিল মালিকদের সিন্ডিকেট নতুন করে সব ধরনের চালে কেজিতে এক টাকা বাড়ালেও ধানের দাম গত এক সপ্তাহে নতুন করে বাড়েনি। বরং নতুন ধান ওঠায় কোনো কোনো জাতের ধানের দাম কিছুটা কমেছে।

এদিকে চালের দামের সঙ্গে পালস্না দিয়ে আটা-ময়দার বাজার উর্ধ্বমুখী করে তোলার নেপথ্যে তিন সিন্ডিকেট তৎপর বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে। এদের মধ্যে ব্রান্ড কোম্পানিগুলোর দুইটি এবং ননব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। বাজার নজরদারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা জানান, সম্প্রতি চালের দাম বৃদ্ধির পর ব্রান্ড কোম্পানির দুই সিন্ডিকেট ময়দার দাম বাড়িয়ে দেয়। এর পরপরই ননব্রান্ড সিন্ডিকেটটিও তৎপর হয়ে ওঠে।

বিশ্ববাজারে গমের দাম স্থিতিশীল রয়েছে এবং গত কয়েক মাসে দেশে প্রচুর পরিমাণে গমেরও আমদানি হয়েছে। তাই আটা-ময়দার দাম আকস্মিক চড়া হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার পেছনে ৫ পরিশোধনকারী কারখানার সিন্ডিকেট কলকাঠি নাড়ছে বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন। তারা জানান, এই সিন্ডিকেটই নির্ধারণ করে বাজারে সয়াবিন তেলের মূল্য। তারা ঠিক করে, দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে কত বাড়াবে, কিংবা আদৌ বাড়াবে কি না?

বিষয়টি স্বীকার করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে মিল মালিকদের কারসাজি দীর্ঘদিনের। তাদের এই কারসাজি ধরতে অতীতে কয়েকবার রিফাইনারি কারখানার প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং টিম কয়েকটি মিলও পরিদর্শন করেছে। নানা অজুহাত দেখিয়ে ভোজ্য তেলের দাম যাতে বাড়ানো না হয় এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বেশকিছু বিধি-নিষেধও আরোপ করেছে। তবে এর পরও তারা ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করেছেন। মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্নভাবে মনিটরিং করার পরও দাম বাড়ানো থেকে তাদের বিরত রাখা যায়নি। তারা শুধু মূল্যবৃদ্ধি নয়, একযোগে কয়েকজন মিলে আকস্মিক আমদানির পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করারও নজির রয়েছে বলে জানায় মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রটি।

এদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সিন্ডিকেটের দায়ভার পড়ছে পুরো ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর। অথচ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত বাজার মনিটরিং এবং অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে বিভিন্ন সময় নানা কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

কারসাজি করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শুধু সামান্য জরিমানা নয়, বড় শাস্তি দেওয়ার হুঁশিয়ারি জানানো হলেও সরকার দীর্ঘ সময়ে এ ধরনের কোনো নজির সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের একাধিক সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে তাদের নজরদারিতে রাখার দাবি তুলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন অযথা কালক্ষেপণ করেছে। অথচ আমদানি ব্যয়ের তুলনায় অতিরিক্ত চড়া দরে পণ্য বিক্রি কিংবা মজুত রেখে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা অন্যায় ও অপরাধ। দেশের প্রচলিত আইনে এদের বিচার করা সম্ভব। যা প্রয়োগে সরকার বরাবর ব্যর্থ হওয়ায় সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট জেঁকে বসার সুযোগ পেয়েছে বলে বাজার পর্যবেক্ষকরা অভিযোগ তুলেছেন।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ