অ্যাকোয়াপনিকস: মাছ চাষ ও মাটি ছাড়া সবজি আবাদ করার যে সমন্বিত পদ্ধতি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে

439

ছোট একটি জায়গায় কেবল একটি অবকাঠামো ব্যবহার করে মাছ এবং সবজি চাষের একটি পদ্ধতি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের অনেকেই এখন এটা ব্যবহার করছেন।

এই পদ্ধতিটি পরিচিত অ্যাকোয়াপনিকস হিসেবে, যেখানে মাটি ছাড়াই সবজি উৎপাদন হয়।

বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, অ্যাকোয়াপনিকস হলো মাছ ও সবজি চাষের একটি সমন্বিত পদ্ধতি।

আর বাংলাদেশে এ পদ্ধতির অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য চাষ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম এ সালামকে।

তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরও আগে থেকেই অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।

অধ্যাপক সালাম মনে করেন যে বাংলাদেশে যেহেতু চাষযোগ্য জমির পরিমান ক্রমশই কমে আসছে, তাই এ দেশে অ্যাকোয়াপনিকস-এর একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে মাছ চাষ ও সবজি আবাদের ক্ষেত্রে।

“যারা ছাদ বাগান করেন বা অল্প জায়গায় মাছ চাষ বা সবজি আবাদ করেন, তাদের জন্য এটি একটি দারুণ বিষয়। একই জায়গায় মাছ ও সবজির ফলন করা সম্ভব এবং তাও একেবারে কম খরচে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

অধ্যাপক সালাম সেই ২০১০ সালে নিজের বাড়ির ছাদে সবজি চাষ শুরু করেছিলেন, আর পরে এর সাথে ২০১১ সালে যোগ করেন মাছ। তবে অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতি তাকে যে সাফল্য এনে দিয়েছে, তা তাকে তাকে কৃষিক্ষেত্রে পদকও এনে দিয়েছে।

অ্যাকোয়াপনিকস কী?

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে যে অ্যাকোয়াপনিকস হলো টেকসই একটি খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা।

এতে মাছ চাষ থেকে আসা ময়লা তথা দূষিত পানি গাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং সেখান থেকে স্বচ্ছ পরিষ্কার পানি পুনরায় মাছের ট্যাংকে ফিরে আসে।

এখানে লক্ষণীয় যে, এ পদ্ধতিতে মাটি ছাড়াই সবজি উৎপাদন করা যায় এবং ব্যাকটেরিয়া পানির সমুদয় বর্জ্য, ময়লা ইত্যাদি তাৎক্ষণিকভাবে দূরীভূত করে – যেভাবে প্রাণীর কিডনি ও লিভার এ কাজটি সম্পন্ন করে থাকে।

অধ্যাপক সালাম বলছেন যে এটি পুরোপুরি একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি।

তিনি বলেন, মূলত মাটি ছাড়া পানিতে গাছপালা ও শাক-সবজি উৎপাদন করার একটি কৌশল হলো অ্যাকোয়াপনিকস। এখানে প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া অনুঘটক হিসাবে কাজ করে মাছের বর্জ্য থেকে গাছকে নিজের খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করে থাকে।

যেভাবে কাজ করে এই পদ্ধতি

অধ্যাপক সালাম জানান, হাইব্রিড এই পদ্ধতি একবার স্থাপন করা গেলে এরপর আর খুব একটা রক্ষণাবেক্ষণের দরকার হয় না।

তার মতে, অ্যাকোয়াপনিকসের প্রাথমিক মূলনীতি হলো মাছ বর্জ্য উৎপাদন করে গাছকে খাদ্যের জোগান দেয় আর গাছপালা মাছের জন্য পানি পরিষ্কার করে – এইভাবে এটি একটি ক্রমাগত চক্র তৈরি করে চলতে থাকে।

তিনি বলেন, যখন মাছ বর্জ্য (অ্যামোনিয়া) উৎপাদন করে, তখন ব্যাকটেরিয়া তাকে নাইট্রেটে পরিণত করে। একটি পাম্প তারপরে এই পানি বহন করে গাছের ট্রেতে নিয়ে যায়। গাছ ওই পানি থেকে নাইট্রোজেন গ্রহন করে পানি পরিষ্কার করে এবং ওই পরিষ্কার পানি আবার মাছের ট্যাঙ্কে ফিরে আসে, যা মাছের জন্য নিরাপদ পানি হিসেবে বিবেচিত হয়।

“এই চক্রটি বারবার নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে”, বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।

“একদিকে মাছ যেমন ব্যাকটেরিয়ার জন্য পুষ্টি সরবরাহ করে, অন্যদিকে ব্যাকটেরিয়া মাছের বর্জ্য ভেঙ্গে নাইট্রেট তৈরি করে গাছের খাদ্যের যোগান দেয়। গাছ আবার পানি পরিষ্কার করে মাছের বসবাস নিরাপদ করে তোলে”।

অ্যাকোয়াপনিকসের বৈশিষ্ট্য:

বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতিতে মাছ ও সবজি চাষ করে নিচের সুবিধাগুলো পাওয়া যায় –

* সহজ প্রযুক্তি ও সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব

* অ্যাকোয়াপনিকস কোন বর্জ্য উৎপাদন করে না

* জৈব খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতি হওয়ায় পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের সুযোগ

* কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সবজি উৎপাদন সম্ভব

* পলিথিন দিয়ে ঘর তৈরি করে সারা বছরই মাছ ও সবজি চাষ করা যায়

* পানি সাশ্রয়ী

* অনুর্বর মাটির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে

* অনুর্বর এবং পতিত জমির সদ্ব্যবহার করে

* পদ্ধতিটি প্রাকৃতিক এবং সারের উৎসস্থল

* খাদ্য পরিবহনজনিত দূষণ হ্রাস করে

* একবার সিস্টেম দাড়িয়ে গেলে পরে আর খরচ নেই

* যে কোন এলাকায় ও যে কোনো আবহাওয়ায় এটি করা সম্ভব

* কোন ধরণের সার ক্রয়-বিক্রয় বা গুদামজাতের দরকার হয় না

অ্যাকোয়াপনিকসের চ্যালেঞ্জ:

তবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই কেবল অ্যাকোয়াপনিকসে সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। এগুলো হলো –

* নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা

* প্রযুক্তি-নির্ভর পদ্ধতি, তাই এ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা

* যন্ত্রপাতি সময়মত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরীক্ষা করা

* মাছকে ঠিক মতো খাবার দেয়া

* মাছ ও সবজি দ্রুততম সময়ে বাজারজাতের ব্যবস্থা

উৎপাদন কেমন হয়?

কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতিতে চাষের জন্য তেলাপিয়া মাছই সবচেয়ে উপযোগী, কারণ এই মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এগুলো অধিক ঘনত্বেও চাষ করা সম্ভব।

এতে করে দুই হাজার লিটারের একটি ট্যাংক থেকে আট মাসেই ১০০-১২০ কেজি তেলাপিয়া উৎপাদন সম্ভব। এর সাথে পুরো বছর ধরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে টমেটো, লেটুস, কচু ও পুদিনা ইত্যাদি ফসল উৎপাদন করাও সম্ভব।

অধ্যাপক এম এ সালাম বিবিসি বাংলাকে অবশ্য বলেন যে তেলাপিয়ার পাশাপাশি কই মাছের চাষের জন্যও দারুণ কার্যকর অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতি, আর এর সঙ্গে থাকতে পারে যে কোন ধরণের সবজি।

তিনি জানান, পুকুরে বা অন্য পদ্ধতিতে চাষের চেয়ে দশগুনের বেশি পরিমাণ মাছ উৎপাদন হতে পারে অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতিতে।

অন্য উদ্যোক্তারা যা বলছেন

তিন বছর ধরে মিরপুরে নিজের বাড়ির ছাদে অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতি সবজি ও মাছ চাষ করছেন বাংলাদেশ বিমানের সাবেক কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান।

মিস্টার রহমান বিবিসি বাংলাকে জানান যে তিনি তেলাপিয়া মাছ চাষের সাথে সবজি হিসেবে ধুন্ধুল, চিচিঙ্গা, লাউ, ঢেঁরস, শিম, কচুশাক, পালংশাক ও কলমিশাক আবাদ করেন।

“ঠিকভাবে যত্ন নিলে দারুণ ফল পাওয়া যায়। আমার আটশো’ লিটারের দু’টি ড্রামে মাছ আছে। ভালোভাবে খাবার দিলেন ৩/৪ মাসেই মাছ প্রত্যাশিত আকার নেয়। আসলে এটিই আগামীর কৃষি হিসেবে জনপ্রিয় হবে,” বলছিলেন তিনি।

তিনি জানান, তার জানা মতে আরও অনেকেই এখন এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে এগিয়ে আসছেন, এমনকি দু’একটি প্রতিষ্ঠানও এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্য বাজারে আনতে শুরু করেছে।

অ্যাকোয়াপনিকসের যত পদ্ধতি:

বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটে অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে বেশ কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

পুকুরে মাচা পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে বাঁশের চটি দিয়ে মাচা তৈরি করা হয়। মাচাটি প্রতিটি আধা লিটার পানি ভর্তি চল্লিশটি বোতল দিয়ে ভাসিয়ে রাখতে হয়। এরপর বোতলের তলায় অনেক ছিদ্র করে তার মধ্যে নারিকেলের ছোবড়া ও নুড়ি পাথর স্তরে স্তরে সাজিয়ে তাতে সবজির চারা লাগিয়ে মাছের পুকুরে স্থাপন করতে হয়।

প্রতিটি মাচায় চারটি করে কচু, পুদিনা, কলমিশাক, ঢেঁড়স ও টমেটোর সর্বমোট ২০টি চারা ব্যবহার করা যায়।

প্লাস্টিকের ড্রাম পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের ড্রাম লম্বালম্বিভাবে কেটে অর্ধেক করে নুড়ি পাথর ও মাটি স্তরে স্তরে সাজিয়ে কচু, পেঁপে ও বেগুনের চারা রোপণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে মাছের ট্যাংকের ময়লা পানি পাম্প করে প্রতিদিন দু’বার ড্রামের নুড়ি পাথরের মাঝে সরবরাহ করা হয়।

এ প্রক্রিয়ায় গাছের শেকড় প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করে এবং পরিষ্কার পানি পুনরায় মাছের ট্যাংকে ফিরে আসে। এ পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন অন্য যে কোনো পদ্ধতির চেয়ে ফলপ্রসূ ও আশাব্যঞ্জক প্রতীয়মান হয়েছে বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে।

আলনা পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল ভবনের ছাদে আলনায় স্থাপন করা হয়। সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি কাঠের আলনায় আনুভূমিকভাবে ৬টি, উপরে নিচে তিন সারিতে ১৮টি এবং উভয় পাশে মোট ৩৬টি বোতল সাজিয়ে রাখা হয়।

বোতলগুলোর ছিপির ভেতরে এক টুকরো স্পঞ্জ দিয়ে তার ওপর নুড়ি পাথর বসিয়ে প্রতি বোতলে দু’টি করে সবজির চারা রোপণ করতে হয়। এতে একটি আলনায় ৩৬টি বোতলে ৭২টি চারা লাগানো যায়।

এভাবে ৫০০ লিটার পানির ট্যাংকে ৩৫০ লিটার পানি দিয়ে তাতে ৬০টি তেলাপিয়া মাছ মজুদ করা যায়।

গ্যালভানাইজড পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে গ্যালভানাইজড পাত দ্বারা ৫”x২”-৫”x১০” আকারের ট্রে তৈরি করে সেখানে পানি নির্গমনের জন্য একটি ৪ ইঞ্চি লম্বা পাইপ স্থাপন করা হয়। এরপর পানিভর্তি একটি ট্রের সাহায্যে ভাসমান মাচা পদ্ধতিতে এবং অপর একটিতে নুড়ি পাথর সাজিয়ে সবজি চাষ করা হয়।

ট্রেগুলোকে একটি ভাসমান বাঁশের মাচার ওপর রাখা হয়। ভাসমান মাচা পদ্ধতিতে চারটি করে টমেটো, লেটুস ও পুদিনার চারা একটি শোলার পাতের মাঝে রোপণ করা হয়। অন্যদিকে, নুড়ি পাথরের ট্রেতে কচু, টমাটো, লেটুস ও কলমিশাক রোপণ করে যথা নিয়মে মাছের ট্যাংকের পানি সরবরাহ করা হয়।

এভাবে আরও কিছু পরিচর্যা করার পর উভয় পদ্ধতিতেই সবজির চারা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায় বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস জানিয়েছে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০৯ আগস্ট ২০২১