অ্যাভোকাডোর চাষ পদ্ধতি

1221

অ্যাভোকাডো হলো মাঝারি আকারের বহুবর্ষজীবী চিরহরিৎ বৃক্ষ। অ্যাভোকাডো ফলের ইংরেজি নাম Avocado এবং বৈজ্ঞানিক নাম Persea americana । অ্যাভোকাডো উচ্চ ফ্যাট এবং প্রচুর ভিটামিনসমৃদ্ধ একটি ফল। অত্যন্ত পুষ্টিগুন সম্পন্ন আভোকাডো উত্তর অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপের বিখ্যাত ফল। এই গাছ আমেরিকা ও মেক্সিকোতে বেশি জন্মায়। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে মেক্সিকোতে এ ফলের উদ্ভাবন হয়। এই ফল থেকে যে তেল উৎপন্ন হয়, তা অ্যাভোকাডো তেল নামে পরিচিত। বর্তমানে ভালুকা (ময়মনসিংহ),বান্দরবন,খাগড়াছড়ি, মধুপুর মিশন ইত্যাদিতে চাষ করা হচ্ছে। ঢাকার কোনো কোনো অভিজাত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেও অ্যাভোকাডো ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে অ্যাভোকাডোর গাছ আছে মাত্র ১৪ টি। তার মধ্যে ভালুকায় ২ টি, মধুপুরে রয়েছে ২টি এবং চাপাইনবাবগঞ্জে ১০টি। তা ছাড়া ভালুকা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসায় ২ টি এবং মল্লিকবাড়ীতে এর বেশ কিছু চারা রোপন করা হয়েছে। চাপাইনবাবগঞ্জের ১০টির মধ্যে দুটি আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারে। হর্টিকালচার সেন্টারের দুটি গাছের মধ্যে একটি গাছে চার বছর থেকে ফল ধরছে। এবার বিশেষ যত্নে এ গাছের ৫৮ টি পরিপক্ব ফল পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ সাইফুর রহমান।

ফলের রং,আকার ও আকৃতিঃ

ফলের রং হালকা সবুজ থেকে কালচে সবুজ হয়ে থাকে। ফলের আকৃতি গোলাকার কিংবা নাশপাতির মতো। ফলের ত্বক পুরু হয়। শাখার অগ্রভাগে গুচ্ছ আকারে ফল ধরে থাকে। পরিপক্ব হওয়ার সাথে সাথে ফলের ভিতরের রঙের পরিবর্তন হয়। পাকা ফল কাটলে পেঁপের মতো কমলা রং ধারণ করে।ফলের ভিতরে একটি বীজ থাকে। জাতভেদে প্রতিটি ফলের ওজন ২০০-৭০০ গ্রাম হয়ে থাকে।

পুষ্টি উপাদানঃ

পুষ্টিবিদদের মতে, প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যকর উপাদানসমৃদ্ধ ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে অ্যাভোকাডো। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, বি, সি, ই এবং কে। এছাড়া এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে কপার, পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাসের মতো খনিজ উপাদান। অ্যাভোকাডোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম আছে, যা কলার চেয়ে ৬০ ভাগ বেশি। এছাড়াও আছে ১৮ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড ও ৩৪% স্যাচুরেটেড ফ্যাট।

সৌন্দর্যচর্চায় অ্যাভোকাডোঃ

অ্যাভোকাডো সৌন্দর্যচর্চায় নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। এর নির্যাস দিয়ে তৈরি হয় মাস্ক, ক্লিনজার, স্ক্রাব যা চেহারায় আনে জৌলুস। বিশেষ করে অ্যাভোকাডো অয়েল থেকে তৈরি হয় কন্ডিশনার, ময়েশ্চারাইজার, ক্লিনজার ও ফেসিয়াল অয়েলের মতো নানা ধরনের সৌন্দর্যপণ্য। ভিটামিন এ এবং গ্লুটামাইন অ্যামিনো অ্যাসিড থাকার কারণে ত্বক পরিষ্কারের জন্য এটি দারুণ কার্যকর। অ্যান্টি এজিং ফল হিসেবেও অ্যাভোকাডো সুপরিচিত। নিয়মিত অ্যাভোকাডো জুস পান করলে চুল পড়া বন্ধ হয়। একে বিউটি এনার্জি ডিঙ্কও বলা হয়। নিয়মিত অ্যাভাকাডো জুস খেলে উজ্জ্বল, কোমল ত্বক তো পাওয়া যাবেই, এটি শরীরের ভেতর থেকে সানস্ক্রিন হিসেবেও কাজ করবে।

মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ুঃ

উষ্ম ও অবউষ্ম মণ্ডলীয় আবহয়ায় ভালো জন্মে। দোআঁশ, উর্বর ও বেলে দোআঁশ মাটি এবং উঁচু জায়গাতে অ্যাভোকাডো চাষ ভালো হয়। এই ফল চাষের জমি সুনিষ্কাশিত এবং রোদযুক্ত হওয়া উচিত । কারণ এ গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। এছাড়া লবণাক্ত মাতিতে গাছ ভালো হয় না। অ্যাভোকাডো চাষের জন্য উপযুক্ত PH ৫-৭। অ্যাভোকাডো চাষের জন্য গড় তাপমাত্রা ১৩ – ২৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস হওয়া সবচেয়ে উপযোগী। তবে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলেও অ্যাভোকাডো চাষ করা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ফুল ও ফল ধারণে ব্যাহত হয়। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এটি উৎপাদন হওয়ায় বানিজ্যিভাবে চাষের সম্ভাবনা রয়েছে।

বংশবিস্তারঃ

বীজের মাধ্যমে খুব সহজেই বংশবিস্তার করা যায়। একটি বীজকে ৪-৬ ভাগ করে কেতে লাগালে প্রত্যেক ভাগ থেকে চারা গোজায়। অবশ্য সেক্ষেত্রে প্রত্যেক ভাগে ভ্রনের অংশ থাকতে হবে। ফল থেকে বীজ বের করার ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। বীজ বপনের আগে বীজের আবরন অপসারণ করলে বীজের অঙ্কুরোদগম ত্বরান্বিত হয়। অযৌনজনন বা অঙ্গজ পদ্ধতিতেও বংশবিস্তার করা যায। জোডকলম বা গ্রাফটিং, গুটিকলম, ভিনিয়ার, টি বাডিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করা যায়।

চারা রোপণের জন্য গর্তঃ

চারা রোপণের জন্য প্রতি গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৮-১০ মিটার। চারা রোপণের জন্য ১ x ১x ১ মিটার গর্ত খনন করতে হবে। পরে গর্তের ২০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম টিএসপি সার ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে ১২-১৫ দিন রেখে দিতে হবে। ১২-১৫ দিন পরে উক্ত গর্তে চারা বা গাছ রোপণ করতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য পরিচর্যাঃ

গোবর সার (কেজি) ১০-১৫

ইউরিয়া (গ্রাম) ৪০০

টিএসপি (গ্রাম) ৩০০

এমওপি (গ্রাম) ৩০০

প্রতিগাছে বছরে ৩ বার সার প্রয়োগ করতে হবে। ফল ধরার পর ১ বার, বর্ষার আগে ১ বার এবং বর্ষার শেষে ১ বার সার দিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।

পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনঃ

পোকামাকড়ঃ

মিলি বাগঃ পোকার আক্রমনে পাতা ও দালে সাদা সাদা তুলার মতো দেখা যায়। এক্ষেত্রে সুমিথিয়ন/ টাফগর/ সানগর/মিপসিন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

মাকড়ঃ মাকড়ের আক্রমনে গাছের পাতাগুলো কুঁকড়ে যায এবং হলুদ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওমাইড/সানমেকটিন/ ভেরটিমেক/রনভিট ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়াও অ্যাভোকাডো গাছে স্কেল ইনসেক্টের আক্রমণও দেখা যায়।

রোগবালাইঃ

ফল ও শিকড়ের পচন রোগঃ এই রোগের আক্রমণে শিকড় ও ফলে পচন দেখা যায়। এক্ষেত্রে নোইন/ কম্প্যানিয়ন/অটোস্টিন/ ডাইথেন এম-৪৫ /রিডোমেল গোল্ড ২ গ্রাম/ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়াও অ্যাভোকাডো স্ক্যাব রোগও হয়ে থাকে।

ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণঃ

কলম থেকে উৎপাদিত গাছে ২-৩ বছরে ফুল আসে। কিন্তু বীজ থেকে উৎপাদিত গাছে ৬-৭ বছরে ফল ধরে। শীতের শেষে অ্যাভোকাডো গাছে ফুল আসে এবং বর্ষা শেষে অর্থাৎ আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ফল পাকে। পাকা ফল গাছ থেকে সহজেই ঝরে পড়ে না বেশ কিছুদিন গাছে রেখে দেওয়া যায়। জাত ভেদে প্রতি গাছে ১০০-৫০০ টি করে ফল ধরে। গাছ থেকে ফল পাড়ার পর ফল নরম হয়। পাকা ফল ৫-৭ ডিগ্রী তাপমাত্রায় ৩০-৩৫ দিন সংরক্ষণ করা যায়।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৮সেপ্টেম্বর২০