আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল, যা জমিতে প্রায় ১৩-১৪ মাস থাকে। একসময় মেহেরপুরে অর্থকরী ফসল হিসেবে আখ চাষ বেশ জনপ্রিয় ছিল। আখ পরিচর্যায় শ্রমিক সংকট ছাড়াও অন্যান্য ফসলের তুলনায় আখের মূল্য না বৃদ্ধির কারণে কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। উচ্চফলনশীল ও স্বল্পসময়ে চাষ করা যায় এমন ফসল চাষ করে বেশি আয় করার ফলে ক্রমেই আখ চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে আখ বিক্রির জন্য সময়মতো পুঁজি না পাওয়া, পোকার আক্রমণে আখ নষ্ট হলেও কীটনাশক না পাওয়াসহ নানা কারণে দিন দিন আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা।
গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসের হিসাবমতে, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় আখ চাষ হয়েছে মাত্র ৪৫ হেক্টর। গত বছরও একই পরিমাণ আখ চাষ করা হয়েছিল। ঈশ্বরদী ১৬ ও ৩২ এবং বিএসআরআই ৪৩ ৪৫ ও ৪৭ জাতের আখ চাষ হয়ে থাকে এ অঞ্চলে। এখানকার মাটি আখ চাষের উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও চাষিরা আখের আবাদ করতে চাচ্ছেন না। তবে অনেকেই গেণ্ডারি আবাদ করছেন এবং আখের সাথি ফসল হিসেবে অন্যান্য ফসল আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন।
রাইপুর ইউনিয়নের শিমুলতলা গ্রামের আখচাষি আব্দুল বাতেন জানান, আখ চাষে নতুন কোনো প্রযুক্তি না আসায় এবং এটি দীর্ঘ মেয়াদের ফসল হওয়ায় প্রতি বছর কমছে এ অঞ্চলে চাষির সংখ্যা। তাছাড়া এখানকার চাষিরা নিজেদের জমিতে উৎপাদিত পুরোনো আখের জাতের বীজই ব্যবহার করছে। ফলে সারা বছর কষ্ট করেও ভালো ফলন পাচ্ছে না। নতুন জাতের আখ চাষ করে কিছুটা লাভবান হওয়া গেলেও কৃষি অফিস থেকে কোনো প্রণোদনা বা পরামর্শ না পাওয়ায় চাষিরা আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
কৃষক লাল মিয়া জানান, আখের ফলন পেতে কৃষককে প্রায় দেড় বছরের মতো অপেক্ষা করতে হয়। তিনি বছর পাঁচেক আগেও তিন বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন। এখন নতুন জাতের আখ যা গেণ্ডারি নামে পরিচিত, সেই জাতের আবাদ করছেন মাত্র ১৫ শতাংশ জমিতে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় আখ ক্ষেতে অনেক বেশি পরিশ্রম ও পরিচর্যা করেও কৃষক খুব একটা লাভবান হন না। অপরদিকে মিল এলাকার চাষিরা সময়মতো আখ বিক্রির পুুঁজি না পাওয়ায় শেয়াল ও পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। এতে ফলন কমে যায়। তাছাড়া এখন কৃষকেরা চান কম সময়ের মধ্যে ফসল ফলিয়ে দ্বিগুণ লাভ করতে। এ কারণেই এ অঞ্চলের সাধারণ কৃষকেরা আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
কুষ্টিয়া চিনিকলের চুক্তিবদ্ধ চাষি শুকুরকান্দি গ্রামের কৃষক হামিদুল ইসলাম বলেন, আখ আবাদে সময় বেশি লাগে। এসময় অন্যান্য জমিতে তিন-চারটি ফসল আবাদ করা সম্ভব। অনেক চাষি আখের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে মসুরি, ভুট্টা, তামাক বা অন্যান্য সবজিও আবাদ করেন। কিন্তু আখের দাম সঠিক সময়ে না পাওয়ায় চাষিরা আর আবাদ করতে চাচ্ছেন না। আখের বদলে ধান-পাট, বেগুন, করলা, শসাসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করছেন। অন্যদিকে বাজারে চিনি বা গুড়ের দাম বেশি হলেও উৎপাদিত আখের দাম একেবারই কম।
বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান আতু জানান, আখের মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে না চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী। চাষিরা সঠিক সময়ে তাদের মূল্য পেতেন না। তাছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে আখ ক্ষেতে থাকে। এ সময়ে অন্তত চারটি ফসল আবাদ করেন চাষিরা। তাই চাষিরা আখ চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন। শুধু চিনিকল নয়, কৃষি অফিস থেকেও চাষিদের প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন। এতে করে আখ চাষ বাড়তে পারে।
গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার ইমরান হোসেন জানান, এই অঞ্চলের মাটি খুব উর্বর হওয়ায় এখানে সারাবছর ধানসহ বিভিন্ন ফসল ফলানো যায়। এতে করে কৃষকেরা জমিতে স্বল্প সময়ে বিভিন্ন ফসল আবাদ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে থাকেন। কিন্তু আখের ফলন পেতে অনেক দেরি হয়। তাই কৃষকেরা আখ চাষ বাদ দিয়ে স্বল্প সময়ে অন্যান্য লাভজনক ফসল চাষের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। তবে কৃষকেরা যদি আখের সঙ্গে অন্যান্য সবজি চাষাবাদ করেন, তাহলে তারা আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হতে পারবেন।