আগর গাছের চাষ পদ্ধতি ও বাজার সম্ভাবনা

1619

আগর-গাছের-চাষ-পদ্ধতি-ও-বাজার-সম্ভাবনা
সুগন্ধি বিশিষ্ট এক ধরনের কাঠ যা সারা বিশ্বে আগর গাছ নামে পরিচিত। আজ কিভাবে আপনি গড়ে তুলতে পারবেন এই আগর গাছের বাগান। আর এই আগর শিল্পের সম্ভাবনা সম্পর্কে। তাই আজকে আলোচনা করা হবে আগর গাছের চাষ পদ্ধতি এবং এর বাজার সম্ভাবনা নিয়ে।

আগর গাছের পরিচিতি:

আগর মূলত একটি গাছের নাম। আগর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উৎকৃষ্ট বা সুগন্ধি বিশিষ্ট কাঠ। ইংরেজিতে এর নাম এলো ওড (Aloe Wood বা Wagle Wood), আরবিতে বলে উদ, দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচিত নাম গাডরউদ, মালয়েশিয়ান ভাষায় গাহারু বলে পরিচিত ও সমাদৃত। বাংলা, আরবি এবং ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে অপভ্রংশ হয়ে আগর নামটির উৎপত্তি হয়েছে। পৃথিবীতে কবে কোথায় আগর-আতরের চাষাবাদ শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস বের করা মুশকিল। তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রেইন ফরেস্টই আগর গাছের আদিস্থান হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। আগর গাছ থেকে বিশেষ কালো রঙের কাঠ পাওয়া যায়, যা আগর কাঠ নামে পরিচিত। স্থানীয় ভাষায় যা ‘মাল’ বলে অভিহিত করা হয়। স্থানীয়ভাবে যারা আগর কাঠ শনাক্ত করেন তাদের ‘দৌড়াল’ বলা হয়।

বাংলাদেশে মূলত Aquilaria agallucha, Aquilaria malaccenesis এবং Aquilaria malaccenesis প্রজাতির আগর গাছ চাষ হয়। ট্যাক্সোনোমিকেলি আগর গাছ Thymelaeaceae পরিবারের অন্তর্গত। আগর গাছ লম্বায় প্রায় ১৫ থেকে ৪০ মিটার এবং বেড় বা ব্যাস ০.৬-২.৫ মিটার হয়। শাখা-প্রশাখবিহীন সোজা লম্বা গাছটি দেখতে এবং আকার আকৃতিতে অনেকটা শাল বা গজারি গাছের মতো। এ গাছে সাদা রঙের ফুল এবং ফলগুলো ক্যাপসুল আকৃতির হয়। আগর গাছের পাতা দেখতে অনেকটা লিচু গাছের পাতার মতো, অনেকে বকুল গাছের পাতার সাথেও মিলাতে পারেন। সাদা রঙের আগর কাঠ খুব নরম হয়। ফলে আতর উৎপাদনের উপকরণ সংগ্রহ ও জ্বালানি কাঠ ছাড়া অন্য কোনো কাজে এ গাছ ব্যবহার হয় না।

আগর-আতরের ব্যবহার:

আগরের সুগন্ধ প্রশান্তিদায়ক, অনেকেই শরীরের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজে লাগে। নানাবিধ ওষুধ, পারফিউম, পারফিউম জাতীয় দ্রব্যাদি-সাবান, শ্যাম্পু এসব প্রস্তুতে আগর তেল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গৃহে, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সুগন্ধি ছড়ানোর জন্য আগর-আতর ব্যবহার করা হয়। আগর আতরের পাশাপাশি আগর কাঠের গুঁড়া বা পাউডার ধূপের মতো প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং মুসলিম ধর্মালম্বী সবাই আগর আতর ও আগর কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করে। আতর বাংলাদেশে তরল সোনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

আগর গাছের উৎপাদন কৌশল:

বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার পাশে, পতিত জমি, টিলার ঢালে, টিলা বা পাহাড়ে এমনকি পরিত্যক্ত জায়গায় আগর গাছ লাগানো যায়। পাহাড় বা টিলা জমিতে আগর গাছ ভালো জন্মে। তবে সব জমিতেই কমবেশি জন্মে।

চারা তৈরিঃ

গাঢ় বাদামি বর্ণের ৩.৮১ সেমি.-৫.০০ সেমি (১.৫-২ ইঞ্চি) লম্বা ক্যাপসুল জাতীয় ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। প্রতি ফলে দুটো বীজ হয়। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা খুব অল্প সময়ের জন্য থাকে। সাধারণত ৭-১০ দিন পর্যন্ত অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা স্থায়ী থাকে। বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়।

বীজ বপনের উৎকৃষ্ট সময় মার্চ-এপ্রিল। চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। প্রথমে বালুর বেডে বীজগুলো বিছিয়ে দিয়ে ওপরে আবারও বালু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এখানে বীজগুলো অঙ্কুরিত হয়। প্রায় ২০-২৫ দিন পরে পলিব্যাগে চারা স্থানান্তরিত হয়। চারা গজানোর জন্য অস্থায়ী শেডের ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। চারায় নিয়মিত পানি সেচের ব্যবস্থা রাখতে হয়।

চারা রোপণঃ

বর্ষা মৌসুম আগর গাছের চারা রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। বাংলাদেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে আগরের চারা রোপণ করলে গাছ টিকে বেশি। স্কুল, কলেজ, রাস্তা দুই পাশেও আগরের চারা রোপণ করা যায়। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিতেও আগর গাছ লাগানো যেতে পারে। রোপণের সময় প্রতিটি গর্তে জৈব সার-কম্পোস্ট সার, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম সার গাছের বয়স অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে।

রোপণের সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব ১.৫২ মি.-১.৮২ মি. (৫-৬ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৯১.৪৪ সে.মি.-১.২২ মি. (৩-৪ ফুট) বজায় রাখা উত্তম। সাধারণত ১-২ বছর বয়সী আগরের চারা লাগানো হয়। একক বাগানের ক্ষেত্রে কম দূরত্ব এবং মিশ্র বাগানের ক্ষেত্রে একটু বেশি দূরত্ব রাখা উচিত। অন্যান্য গাছের মতো চারা রোপণের পূর্বে দৈর্ঘ্যে ৫০ সেমি প্রস্থে ৫০ সেমি এবং গভীরতায় ৫০ সেমি আকারের গর্ত তৈরি করে পচা গোবর ও সার প্রয়োগ করা ভালো।

আগর গাছের সাথে আন্তঃফসলঃ সাধারণত প্রথম ৩-৫ বছর পর্যন্ত মিশ্র ফসল যেমন শাকসবজি ও ডাল জাতীয় ফসল চাষ করা যায়। পরবর্তীতে কয়েক বছর ছায়া পছন্দকারী সর্পগন্ধা ঔষধি গাছের আবাদ করা যায়। আদা এবং হলুদও চাষ করা হয়। তাছাড়া সুপারি, কফি, রাবার, পামগাছসহ অধিকাংশ বনজ গাছ আগর গাছের সাথে মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। বিভিন্ন দেশে এলাচও চাষ করে।

আন্তঃপরিচর্যাঃ

খরা মৌসুমে পানি সেচ দিতে হয়। প্রয়োজনমতো আগাছা দমন করতে হবে। তাছাড়া নিয়ম করে কিছু রাসায়নিক সার দিলে গাছের বৃদ্ধি দ্রুত হয়। এক্ষেত্রে নতুন আগর গাছের বাগানে কোনো রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয় না। আগর গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সার ব্যবহার করা যায়। একবার বর্ষার আগে এবং একবার বর্ষার পরে অর্থাৎ বছরে দুইবার সার প্রয়োগ করা উত্তম।

আগরের রোগ-বালাইঃ

আগরের তেমন কোনো রোগ হয় না তবে মাঝে মাঝে গোড়া পচা রোগ এবং ডাইব্যাক রোগে গাছের ডালপালা শুকিয়ে যায়। প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায়। আগর চাষের ক্ষেত্রে বিছা পোকা পাতা ঝাঁঝরা করে ফেলে। সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করে বিছা পোকার আক্রমণ দমানো যায়।

আগর সংগ্রহের সময়ঃ

প্রাকৃতিকভাবে আগর গাছে আগর তৈরি হতে ২৫-৩০ বছর সময় লেগে যায়। তবে কৃত্রিমভাবে ৫-৬ বছর বয়সী আগর গাছে পেরেক মেরে এসব গাছ ১৫-১৬ বছর হলেই আগর কাঠ সংগ্রহ করা যায়। আগর কাঠ সংগ্রহের জন্য গাছ কর্তনের উপযোগী হয়েছে কিনা তা বিবেচনা করা হয় মূলত গাছ কতটুকু রুগ্ন হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে।

গাছের বয়স, গাছের বৃদ্ধি ও শারীরতাত্ত্বীয় পরিপক্বতা বিবেচনা করে আগর গাছ কর্তন করা হয় না বরং গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া, দৃশ্যমান ক্ষতযুক্ত কাণ্ড, কাঠের বিকৃতি, ক্ষুদ্র পাতা, মূল কাণ্ড ও শাখার ওপর মরা লক্ষণ এসব দেখে আগর কাঠ কর্তন করা ও সংগ্রহ করা হয়। সারা বছরই আগর কাঠ সংগ্রহ করা গেলেও জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসই আগর কাঠ সংগ্রহের উৎকৃষ্ট সময়। এ সময় গাছ সুপ্ত অবস্থায় থাকে বলে আগর কাঠে আতর বা তেলের পরিমাণ বেশি ও গুণগত মানের পাওয়া যায়। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক গাছ থেকে ২.০-২.৫ কেজি পরিমাণ আগর কাঠ পাওয়া যায়।

আগর গাছে দুইভাবে আগর তৈরি হয়।প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ও কৃত্রিম পদ্ধতিতে।

প্রাকৃতিক পদ্ধতিঃ

প্রাকৃতিক উপায়ে আগর গাছ হতে আগর উৎপন্ন হতে প্রায় ২৫-৩০ এমনকি ৫০ বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে আগর গাছের বয়স ৫-১০ বছর থেকেই গাছে আগর জমা হতে থাকে। এক্ষেত্রে গাছের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে কালো বর্ণ ধারণ করে। দেখতে ছোপ ছোপ আকারে অনেকটা সারি কাঠের মতো। তবে সারি কাঠ যেমন অনেকটা বা পুরোটা অংশজুড়ে কালো হয় এক্ষেত্রে ঠিক তেমনটি হয় না। আগর গাছে নির্দিষ্ট স্থানে কালো হওয়া শুরু হলে তা পূর্ণ হতে প্রায় ৪-৬ বছর লেগে যায়। এটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি। গাছের এ কালো অংশকেই বলা হয় আগর বা আগর কাঠ।

কৃত্রিম পদ্ধতিঃ

এক ধরনের কাণ্ড ছেদক পোকা আগর গাছে ছিদ্র তৈরি করে পরে সেখানে ছত্রাকের আক্রমণে গাছ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে জৈবনিক প্রক্রিয়ায় আগর গাছের ওই ক্ষত স্থানের চারপাশে বাদামি-কালো রঙের আস্তরন তৈরি হয় যা আগর উৎপাদনের মূল উপকরণ। এ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ কৃত্রিমভাবে পেরেক মেরে ক্ষত সৃষ্টি করে, ফলে সেখানে আগর সঞ্চিত হয়। এ পদ্ধতিতে খুব কম সময়ে আগর গাছ থেকে আতর তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব।

এ পদ্ধতিতে ১০-১২ বছরের ১০-১২ ইঞ্চি পরিধির আগর গাছের গায়ে ৪-৫ ইঞ্চি পরপর সারিবদ্ধভাবে গাছের নিচ থেকে শুরু করে ওপর পর্যন্ত প্যারেক (তারকাটা) গেঁথে দেওয়া হয়। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ২.৫৪ সে.মি.-৫.০০ সে.মি. (১-২ ইঞ্চি) পরপর সারিবদ্ধভাবে ৩.৮১ সে.মি.-৫.০০ সে.মি. ১.৫ থেকে ২.০ ইঞ্চি সাইজের তারকাটা ৪-৫ বছর বয়সী গাছে লাগানো হয়েছে। তারকাটা লাগানোর সময় একটা কৌশল হিসেবে অর্ধেক অংশ পরিমাণ তারকাটা গাছের কাণ্ডে ডুকানো হয়, একটু আড়াআড়িভাবে লাগানো পেরেকের বাহিরের অংশটুকু গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে কাণ্ডের ভেতর ডুকে যায়।

গাছের তারকাঁটা গাঁথা অংশে কৃত্রিমভাবে আঘাতের ফলে ছত্রাকের আক্রমণ সহজেই ঘটে ফলে তারকাঁটার চারপাশের কাঠে ৫-৬ বছরের মধ্যেই বাদামি-কালো রঙের আস্তরণ তৈরি হয়। পরে সে গাছগুলো কেটে আগর-আতর উৎপাদনের কাঁচামাল বের করা হয়। সাধারণত গাছের পুরুত্ব ও আকারের ওপর তারকাঁটা পোতা নির্ভর করে। এক্ষেত্রে গাছের বয়সটা মুখ্য নয়।

আতর প্রস্তুত করার কলাকৌশলঃ

আগর বাগান থেকে পূর্ণ বয়স্ক আগর গাছ কেটে এনে প্রথমে তা টুকরো টুকরো (স্থানীয় ভাষায় লগ) করে কেটে আলাদা করা হয়। এ টুকরোগুলোকে দুইভাগে আলাদা করা হয়। এক ভাগে ঘন কালো, হালকা কালো, তামাটে, অল্প তামাটে বর্ণের কাঠের টুকরা এবং অন্য ভাগে ধূসর, প্রায় সাদা বর্ণের কাঠের টুকরা থাকে। হালকা কালো, তামাটে ও অল্প তামাটে রঙের আগর কাঠের লগগুলোকে লম্বালম্বিভাবে চেরা হয়।

লম্বালম্বি চেরাগুলোকে ফালি বলা হয়। ফালিগুলো থেকে সাবধানতার সাথে তারকাটাগুলোকে সরানো হয়। ফালিগুলো অত্যন্ত যতœ ও সুনিপুণভাবে করা হয় যেন কালো অংশ বা আগরগুলো আস্ত থাকে। চেরা ফালিগুলো স্থানীয় ভাষায় ধুম বলে। কারখানাগুলোতে ধুম তৈরির কাজগুলো মূলত মহিলারা করেন। ধুম করার পর কাঠের ফালিগুলোকে কুচি কুচি করে কাটা হয়। চেরা ফালিগুলো (ধুম) কুচি কুচি করতে দা ব্যবহারের পাশাপাশি অনেক কারখানায় মেশিন ব্যবহার করা হয়।

এরপর কুচি কুচি করে কাটা টুকরোগুলো একটি পাত্রে বা পানির ট্যাঙ্ক, ড্রাম, বড় হাঁড়িতে (স্থানীয় ভাষায় ডেগ বলে) ১০-১৫ দিন পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখা হয়। ভিজিয়ে রাখা কাটা কাঠগুলো তুলে চালনির সাহায্য পানি ঝড়িয়ে ঢেকি দিয়ে গুঁড়া করা হয়। স্থানীয় ভাষায় কাঠের গুঁড়া অংশগুলোকে ছুরন বলা হয়। ছুরনগুলোকে আবারও কমপক্ষে ৮-১০ দিন ভিজিয়ে রাখতে হয়।

উল্লেখ্য যে, ডেগে ভিজিয়ে রাখার ব্যাপারে অনেকে ২ বার আবার অনেকে ১ বারও করে থাকে। ছুরনগুলো খুব ভালোভাবে পচে গেলে ডেগ থেকে তুলে নিয়ে একটি পানি ভর্তি স্টিলের তৈরি বিশেষ পাত্রের মধ্যে রেখে পরবর্তীতে নিচ থেকে আগুনে তাপ দিতে হয়। পাত্রের চারিদিক খুব ভালোভাবে বন্ধ করা থাকে, অনেকটা এয়ার টাইটের মতো। এভাবে অনবরত ১০-১২ দিন তাপ প্রয়োগ করতে হয়।

পাত্রের ওপরের দিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় একটা নল সংযুক্ত করা হয় এবং নলটির অপরপ্রান্ত আরেকটি পাত্রের সাথে সংযুক্ত করা থাকে। নলটি অন্য একটি ঠাণ্ডা পানি ভর্তি স্টিলের তৈরি দিয়ে পরিচালিত করে অন্য পাত্রের সাথে সংযুক্ত করা হয়।

এখানে স্টিলের তৈরি পাত্রটিতে ঠাণ্ডা পানি ভর্তি থাকে, ফলে নলের মধ্য দিয়ে ভেসে আসা বাষ্পগুলো ঠাণ্ডা পানির সংস্পর্শে এসে সহজেই ফোটায় ফোটায় পানিতে পরিণত হয়, ফোটায় ফোটায় পানিগুলো নলের অপর প্রান্তে রাখা পাত্রে জমা হয়। আগুনের তাপে ছুরন কাঠ সিদ্ধ হয়ে বাষ্পাকারে ওপরের নলে প্রবেশ করে এবং বাষ্পগুলো ঘনীভূত হয়ে অপর প্রান্তের পাত্রের মধ্যে ফোটায় ফোটায় পড়তে থাকে।

ঘনীভূত বাষ্প পানি হয়ে নির্দিষ্ট পাত্রে জমতে থাকে এবং তার ওপর তেলের আস্তরণ পড়ে। তেলের এ আস্তরণই আগর আতর তেল। পরবর্তীতে পানির ওপর থেকে তেলের অংশটিকে সংগ্রহ করা হয়। এটি মূলত বাষ্পীভবন-শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় বিশেষ পাতন প্রক্রিয়া।

এক সঙ্গে একটি ডেগে ৭৪.৬৫ কেজি-১১২.০০ কেজি (২-৩ মণ) পরিমাণ ছুরন (আগর চিপস/আগর কাঠের টুকরো) ভর্তি করা যায়। এক ডেগ ছুরন জ্বাল দিয়ে ৮-৯ তোলা আতর পাওয়া যায়। একতোলা আতর প্রায় ১২ গ্রাম পরিমাণ। প্রাপ্ত তথ্য মতে, আতর বের করার পর উচ্ছিষ্টগুলো আগর বাতির ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করা হয়। তাছাড়া উচ্ছিষ্ট অংশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করা হয়।

আগরের বাজার ব্যবস্থাপনাঃ

বিশ্বে আগর আতর পণ্যের প্রায় ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি বাজার রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আগর উড চিপস ও আতরের খুব চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে আগর কাঠের বিভিন্ন প্রকার মান রয়েছে যথা- ডবল সুপার, আগর প্রপার, কলাগাছি আগর, ডোম আগর। আগর আতর শিল্প থেকে দেশি ও বিদেশি অনেক আতর তৈরি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জান্নাতুল নাঈম, জান্নাতুল ফেরদাউস, শাইখা, হাজরে আসওয়াদ, সুলতান, উদ, কিং হোয়াইট, আল ফারেজ, কুল ওয়াটার এসব নামের আতর বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।

আগর কাঠের বাজারদর প্রতি কেজি পাঁচ ডলার থেকে দশ হাজার ডলার। গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে এক তোলা আতর ৫-১৫ হাজার পর্যন্ত বিক্রি হয়। তাছাড়া আগর গাছের ডাস্ট বা উচ্ছিষ্টগুলোও রপ্তানিযোগ্য। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশে এসব ডাস্ট প্রক্রিয়াজাত করে ২০-২২টি পণ্য উৎপাদন করে। আগর তেলের মান বহুবিদ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মান অনুযায়ী আগর কাঠের দামও কম-বেশি হতে পারে।

প্রাথমিক বিবেচনায় দাম নির্ধারণে কাঠের মান ও উৎপাদনকারী দেশের ওপর নির্ভর করে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের গ্রাহক বা ব্যবসায়ীরা ভিন্ন ভিন্ন গুণাবলি বিবেচনায় রেখে আগর কাঠের মান-দাম নির্ধারণ করে থাকেন। মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে আগর কাঠের তেল থেকে প্রাপ্ত গন্ধ বা সুরভী মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সিঙ্গাপুর আগর ব্যবসার মূলকেন্দ্র। প্রধান প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া অন্যতম।

লাভজনক ব্যবসা আগর শিল্পঃ

আগর-আতর উৎপাদন অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। এ ব্যবসায় অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে বেশি মুনাফা আয় করা সম্ভব। এক কেজি কালো কাঠের মূল্য প্রায় ২ লাখ টাকা। একটি আগর কাঠসমৃদ্ধ প্রাপ্ত বয়স্ক গাছের মূল্য ৫-১০ লাখ এমনকি ২০-২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, আগর প্লান্টেশনে বিনিয়োগ করে উচ্চ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। অন্য জরিপে জানা যায়, সঞ্চয়পত্রে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে ১২ বছর পর ৪.২১ ডলার পাওয়া যায়, অপরদিকে আগর গাছে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে ১১৭ থেকে ৭৩৬ ডলার আশা করা যায়। তাছাড়া আগর শিল্প একটি পরিবেশবান্ধব শিল্প।

আগর শিল্প বিকাশে সুপারিশমালাঃ

আগর আতর শিল্পের বিকাশে এ শিল্পকে ঢেলে সাজাতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, পলিসি, উদ্যোগ ও উদ্যোগের যথাযথ বাস্তবায়ন। আগর শিল্পের মানোন্নয়নে সুপারিশ হলো সরকারি উদ্যোগে আগর নিয়ে আধুনিক মানসম্মত গবেষণা করা; ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, উদ্যোক্তা, আগর শ্রমিক, কারিগরদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আগর থেকে বিশ্বমানের প্রসাধনী পণ্য সামগ্রী তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করা; সরকারি উদ্যোগে ঋণ সুবিধা প্রদান করা; সরকারি খাস জমি বিশেষ করে টিলাগুলো লিজ প্রদান করা; আগর শিল্পের জন্য পৃথক অবকাঠামো ও বিসিক শিল্প নগরী স্থাপন করা;

গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল খাতে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা; রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজতর করতে ফরওয়ার্ড লিংকেজের ব্যবস্থা করা; প্রাকৃতিক আগর দিয়ে উৎপাদিত প্রসাধনীর আনুষাঙ্গিক রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানি সুবিধা বৃদ্ধি করা (শুল্কমুক্ত করা) যাতে দেশীয় পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করে অধিক মূল্যে রপ্তানি করা সহজতর হয় ট্যাক্স হলিডে (শুল্ক রেয়াত) সুবিধা দেয়া। সমন্বিত গবেষণার জন্য আগর উন্নয়ন বোর্ড-সেল গঠন করা। সরকারি উদ্যোগে গবেষণা এবং প্যাটেন্টরাইট প্রদানের ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি কৃষি বিভাগ, বন বিভাগ, কাস্টমস বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, বিজিবি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা।

বাংলাদেশে আগর শিল্পের সম্ভাবনাঃ

বাংলাদেশে বর্তমানে সিলেট তথা মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আগর চাষ করার উপযোগী জায়গা রয়েছে। গতানুগতিক বা সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে কৃত্রিম পদ্ধতির মাধ্যমে স্বল্প সময়ে বেশি পরিমাণ আগর ও আগরজাত দ্রব্যাদি উৎপাদন করা সম্ভব। বড়লেখা উপজেলায় ছোট বড় প্রায় ৩০০ টি আগর আতর ফ্যাক্টরি রয়েছে। এ এলাকায় পরিকল্পিতভাবে আরও আগর কারখানা তৈরি সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশি অনেক ব্যক্তি দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আগর শিল্প গড়ে তুলেছেন। এসব শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকই বাংলাদেশি। কাঁচামাল আমদানি সংক্রান্ত জটিলতা দূরীভূত হলে আমাদের দেশে এ শিল্পগুলো স্থাপন করা সম্ভব হবে এবং দেশীয় শ্রমের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে ফলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে।

আগর-আতর শিল্পে সরকারি উদ্যোগঃ

আগর গাছ ও আতর একটি অতি মূল্যবান সম্ভাবনাময় সুগন্ধি। আভিজাত্যের প্রতীক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে এখনও এ আগর শিল্পটি অবিকশিত। অত্যন্ত শক্তিমান এ সম্পদ মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া জাপান, ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশেও প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

চাহিদা বৃদ্ধির সাথে রপ্তানিমুখী এ শিল্পের বিকাশে জরুরি ভিত্তিতে আগর গাছের ওপর গবেষণা জোরদার, চাষ সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনাসহ প্রক্রিয়াজাতকরণে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে আধুনিকায়ন করার উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা উচিত। ব্যক্তি কর্তৃক উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে এসে সরকারি মাধ্যমে রপ্তানি নিশ্চিত করা দরকার। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং গ্রামীণ জনপদের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাছাড়া পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখা সম্ভব। এ শিল্পের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে, ফলে দেশের সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক হবে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/৩১মার্চ২০