মূলা শীতকালের অন্যতম প্রধান সবজি। মূলা সকল শ্রেণীর মানুষের পছন্দের সবজি। মূলা সালাদ, ভাজি ও অন্যান্য তরকারির সাথে ব্যবহার করে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে আমাদের সমাজে। মুলার পাতা অনেকেই শাক হিসেবে খেতে বেশি পছন্দ করে থাকেন। মূলার পাতার শাক বেশ পুষ্টিকর। শাকে প্রচুর পরিমানে ক্যারোটিন, ভিটামিন সি,ক্যালসিয়াম ও লৌহ রয়েছে। এখন চাষিরা অমৌসুমে মূলা আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ইতোমধ্যে বৃষ্টি পানি জমি থেকে নেমে গেছে বা নেমে যেতে শুরু করেছে। এসব জমিতে আগাম মূলার চাষ করা যেতে পারে। আগাম সবজি হিসেবে মূলার যথেষ্ট বাজার রয়েছে। তাছাড়াও বাজারে পেঁয়াজ ও শসার দাম বেশি থাকালে এদের বিকল্প সবজি হিসেবে মূলার ব্যবহার বেড়ে যায়। খরিপ মৌসুম শেষে এবং রবি মৌসুমের শুরুতে বাজারে তেমন কোন সবজি পাওয়া যায় না। এই সময়ে আগাম জাতের সবজির মধ্যে মূলা উন্নতম। এখন আগাম মুলা চাষের মাধ্যমে আমরা আর্থিক লাভবান হতে পারি।
মূলার জাত: একসময় জাপানের বিখ্যাত তাসাকি সান জাতের মূলার মাধ্যমে এ দেশে উচ্চফলনশীল মূলার আবাদ শুরু হলেও এখন মূলার বেশ কিছু জাত চাষ হচ্ছে। আসছে নিত্য নতুন স্বল্প জীবনকালের অধিক ফলনশীল হাইব্রিড জাত। উল্লেখযোগ্য জাত সমূহ হল বারি মূলা ১, বারি মূলা ২, বারি মূলা ৩, এভারেষ্ট, হোয়াইট প্রিন্স, বিপ্লব ৯৪, হিমালয় এফ১, সুপার ৪০, মুক্তি এফ১, তাসাকী, কুইক ৪০, রকি ৪৫, হোয়াইট রকেট, হোয়াইট ৪০, জি চেটকি, সুফলা ৪০, বিএসবিডি ২১০১ এফ১, আনারকলি, দুর্বার, রকেট এফ১, সামার বেষ্ট এফ১, বরকতি ৪০ এফ১, পাইলট এফ১, সিগমা ৪০ ইত্যাদি। মূলার কয়েক টি জাতের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি –
বারিমূলা ১ (তাসাকিসান)- ভাদ্র থেকে কার্তিক মাসে বীজ বুনতে হয়। বীজ বোনার ৪০-৪৫ দিন পর থেকেই মূলা তোলা যায়। মূলার রঙ ধবধবে সাদা, বেলুনাকৃতি, লম্বা ও বড়, দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩৫ সেন্টিমিটার, প্রতিটি মূলার গড় ওজন ১ কেজি। দেশী মূলার মত অত ঝাঁঝ নেই। প্রতি বিঘায় ফলন ৭-৮ টন।
বারিমূলা ২ (পিংকী)- ভাদ্র থেকে কার্তিক মাসে বীজ বুনতে হয়। বীজ বোনার ৪০-৪৫ দিন পর থেকেই মূলা তোলা যায়। মূলার রঙ লালচে, নলাকৃতি, দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৫-৩০ সেন্টিমিটার, মধ্যমাকার, প্রতিটি মূলার গড় ওজন ৯০০ প্রাম। শাক খাওয়ার উপযুক্ত। প্রতি বিঘায় ফলন ৭-৮ টন।
বারিমূলা ৩ (দ্রুতি) – ভাদ্র থেকে কার্তিক মাসে বীজ বুনতে হয়। বীজ বোনার ৪০-৪৫ দিন পর থেকেই মূলা তোলা যায়। মূলার রঙ সাদা, নলাকৃতি। পাতার কিনারা ঢেউ খেলানো। মূলার অর্ধেক অংশ মাটির উপরে থাকে। প্রতিটি মূলার গড় ওজন ৪০০-৬০০ গ্রাম। প্রতি বিঘায় ফলন ৫-৬ টন। রোগ পোকার আক্রমণ প্রতিরোধী। এ দেশের আবহাওয়ায় এ জাতের মূলার ভাল বীজ উৎপাদন করা যায়।
এভারেষ্ট এফ১- সারা বছর চাষ করা যায়। একই জমিতে একই মৌসুমে ৩ বার চাষ করা যায়। সহজে ফুল আসেনা। বীজ বোনার ৪০-৪৫ দিন পর থেকেই মূলা তোলা যায়। মূলার রঙ সাদা, নলাকৃতি, ছোট আকারের, প্রতিটি মূলার গড় ওজন ৪০০-৫০০ গ্রাম। শাক খাওয়ার উপযুক্ত। প্রতি বিঘায় ফলন ৭-৮ টন।
হোয়াইট প্রিন্স এফ১- মধ্য শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাসে বীজ বুনতে হয়। বীজ বোনার ৪০-৪৫ দিন পর থেকেই মূলা তোলা যায়।আগাম, দ্রুত বর্ধনশীল, ঝাঁঝহীন ও সুস্বাদু ,প্রতিটি মূলার গড় ওজন ৩০০-৪০০ গ্রাম। শাক খাওয়ার উপযুক্ত। প্রতি বিঘায় ফলন ৭-৮ টন।
মিনো আর্লি লং হোয়াইট আশ্বিন থেকে অগ্রহায়ণ মাসে বীজ বুনতে হয় ও পৌষ ফাল্গুনে মূলা ওঠে। বীজ বোনার ৪০-৪৫ দিন পর থেকেই মূলা তোলা যায়। মূলা লম্বা, সাদা, গ্রীস্মকালে ভাল হয়। প্রতিটি মূলার গড় ওজন ২৫০-৪০০ গ্রাম হয়ে থাকে প্রতি বিঘায় ফলন ৬-৭ টন।
জমি ও মাটি: উঁচু মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নিচু জমিতে মূলা চাষ করা যায়। সুনিস্কাশিত বেলে দোয়াশ মাটি মূলা চাষের জন্য ভাল। এটেল মাটিতে মূলার বাড় বাড়তি কম হয়। মূলা চাষের জন্য জমি গভীরভাবে ধুলো ধুলো করে চাষ করতে হয়। ছাই ও জৈব সার বেশী ব্যবহারে মূলার বাড় বাড়তি ভালো হয়।
সার প্রয়োগ: আগাম চাষে মূলার অধিক ফলনের জন্য বিঘা প্রতি গোবর বা আবর্জনা পচা সার ১.৫ থেকে ২ টন, জমি তৈরির সময় সবটুকু জৈব সার দিতে হবে। ট্টিপুল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সার ২০ কেজি, ইউরিয়া সার ৪০-৪৫ কেজি ও মিউরেট অব পটাশে (এমওপি) ২৫-৩০ কেজি ব্যবহার করতে হবে। টিএসপি সব ও এমওপি সারের অর্ধেক মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া ও বাকি অর্ধেক এমওপি সার সমান ২ কিস্তিতে ভাগে ভাগ করে বীজ বপনের পর তৃতীয় ও পঞ্চম সপ্তাহে ছিটিয়ে সেচ দিতে হবে। মূলার বীজ উৎপাদন করতে হলে জমিতে অবশ্যই বোরন সার হিসেবে বোরিক পাউডার/বোরক্স ব্যবহার করতে হবে। প্রতি বিঘায় ২ কেজি বোরিক এসিড/বোরাক্স দেওয়া প্রয়োজ।
বীজ বপন: বিঘা প্রতি ৩৫০-৪০০ গ্রাম বীজ লাগে। সাধারণতঃ কৃষকগন মূলার বীজ ছিটিয়ে বপন করে থাকেন। তবে মূলার ভাল ফলন ও যতœ পরিচর্যার সুবিধার্থে এবং বীজের পরিমাণ কম লাগার জন্য বীজ লাইন করে বুনা ভাল। লাইন করে বুনার ক্ষেত্রে বেড তৈরি করে তারপর বীজ বুনতে হবে। বেড তৈরি সময় প্রস্থ ৩ ফুট এবং জমির আকৃতির উপর নির্ভর করে দৈর্ঘ্য ঠিক করে নিতে হবে। প্রতি বেডের চারি ধারে দেড় ফুট নালা রাখতে হবে। সারি থেকে সারির দুরত্ব হবে এক থেকে দেড় ফুট এব্ ংবীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ৮ ইঞ্চি। বীজ বপনের সময় সূস্থ সবল ও সতেজ বীজ আধা ইঞ্চি মাটির নিচে দিতে হবে।
পরিচর্যা: বীজ বপনের ৭-১০ দিন পর অতিরিক্ত চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে। গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে বেশি জায়গার দরকার হয়। তাই চারা অবস্থায় চারার ঘনত্ব বেশি হলে কয়েক দফায় চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে। তুলে নেওয়া চারাগুলো বাজারে বিক্রি করা যেতে পারে। মাটিতে রস কম থাকলে সেচ দিতে হবে। প্রতি কিস্তির সার উপরি প্রয়োগের পর পরই সেচ দিতে হবে। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মাঝে মাঝে নিড়ানী দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে দিতে হবে।
মধ্যবর্তি সমেয় সার প্রয়োগ : মূলা ৪/৫ পাতা হলে (৩য় সপ্তাহ) বিঘা প্রতি ইউরিয়া ৫-৭ কেজি এবং মিউরেট অব পটাশ ৮-১০ কেজি একত্রে মিশিয়ে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। আবার মূলার যখন ৮/৯ পাতা হবে (৫ম সপ্তাহ) তখন ইউরিয়া ও মিউরেট অব পটাশ সার একই মাত্রায় উপরি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে কুয়াশা বা বৃষ্টি ভেজা পাতা শুকানোর পর সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে প্রয়োজনে হালকাভাবে দু‘একবার পানি সেচ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। মূলার জমিতে পানি জমে থাকেলে মূলা পচে যেতে পারে এজন্য মূলার জমিতে ভাসান সেচ বা প্লাবন সেচ দেয়ার প্রয়োজন নেই। সেচ দেয়ার পর মাটিতে ‘জো’ এলে চটা ভেঙ্গে দিতে হবে এতে মূলার বৃদ্ধিও ভাল হবে।
লেখক:মো. এমদাদুল হক
এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৭আগস্ট২০