স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে বেশি করে ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে দেশের অপুষ্টির চিত্র আমূল পাল্টে যাবে। জনগণের মাঝে সচেতনতা গড়তে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার (১২ অক্টোবর)বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পোল্ট্রির নানাবিধ উপকারিতার কথা তুলে ধরা হয়।
সরকারের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে।
আলোচনা সভার প্রধান অতিথি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, ডিম খাওয়ার কোন বয়স নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই ডিম খেতে পারেন।
তিনি ঋণের ব্যাপারে তিনি বরেন, প্রান্তিক খামারিদের জন্য সিঙ্গেল ডিজিটে ক্ষুদ্র ঋণ এবং কৃষি রেটে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা ভাবছে সরকার।
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ডিমে স্বয়ং সম্পুর্ণ হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন ডা. হীরেশ।
ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশনের আদলে বাংলাদেশেও একটি এগ কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি।
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সাল নাগাদ যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করতে হলে ডিমের মাথাপিছু কনজাম্পশন অন্তত: দ্বিগুণ করতে হবে-প্রতিটি মানুষকে দৈনিক অন্তত: একটি করে ডিম খাওয়ার অভ্যাস ও আর্থিক সক্ষমতায় উন্নীত করতে হবে।
বিপিআইসিসি’র সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, চাল, চিনি, দুধ, আটা এমনকি লবণের বিজ্ঞাপনও গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় কিন্তু সাধারণত ডিমের কোন বিজ্ঞাপন দেখা যায় না আমাদের দেশে। ডিম বিক্রি থেকে যে লাভ পাওয়া যায় তা দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। তাই একাজে তথ্য মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাচ্চারা যেন সপ্তাহে অন্তত দু’টি ডিম খায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। ডিমের ইতিবাচক প্রচারণায় তিনি চিকিৎসক, পুষ্টিবিদ ও রন্ধনশিল্পীদের সহযোগিতা চান। ভ্যালু অ্যাডেড ডিম নিয়ে গবেষণায় সহযোগিতার আশ্বাস দেন মসিউর রহমান।
তিনি বলেন, বিগত প্রায় এক বছর ডিমের দাম না পেয়ে অনেকেই খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। এদিকে এইচ৯এন১ ভাইরাসের সংক্রমণে ডিমের উৎপাদন কমে গেছে। সার্বিক বিচারে ডিমের উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে উদ্যোক্তারা উৎপাদন বাড়াতে ইতোমধ্যেই উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানান বিপিআইসিসি সভাপতি।
ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ডিমের চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১০-১৬ মেয়াদে ডিমের মাথাপিছু কনজাম্পশন ৭.২ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩.৫৮ গ্রাম। এই মেয়াদে গরুর গোশতের কনজাম্পশন ১০ শতাংশ ও মাছের কনজাম্পশন ২৬ শতাংশ বেড়েছে কিন্তু ডিমের কনজাম্পশন বেড়েছে ৮৮ শতাংশ।
খালেদ বলেন, বিপিআইসিসি’র হিসাবমতে, দেশে বর্তমানে ডিমের বাণিজ্যিক উৎপাদন দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং গৃহপালিত মুরগি, হাঁস ও কোয়েল পাখির ডিম হিসাব করলে দৈনিক গড় উৎপাদন ৪ কোটি ৭১ লাখের ওপরে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১,৬৬৫ কোটি পিস। এর মধ্যে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর -এই তিন মাসে ডিমের মোট উৎপাদন হয়েছে ৪৩৩.৫৩ কোটি পিস। প্রতিটি ডিমের গড় মূল্য ৭ টাকা ধরা হলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় ৮,৩৩৮.৬৮ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ১০,৪৫২.১২ কোটি টাকার ডিম কেন্দ্রিক বাণিজ্য হয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রায় ১১,৬৫৫ কোটি টাকারও অধিক ডিম কেন্দ্রিক বাণিজ্য হবে বলে আশাকরা যায়।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ডিম দিবসে এবারের থিম হচ্ছে “Protein for Life” আর বাংলাদেশে আমাদের স্লোগান হচ্ছে “সুস্থ-সবল জাতি চাই, সব বয়সেই ডিম খাই”।
কিনোট ম্পিকার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী এবং বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন নাহার নাহিদ বলেন, ডিম নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে ডিম হার্টের জন্য উপকারি, ডিম খেয়ে ওজন কমানো যায়, ব্রেন ডেভেলপমেন্ট এবং হাড় মজবুত করতে ডিম অত্যন্ত কার্যকর। ডায়াবেটিসের রোগিরাও ডিম খেতে পারবেন। অনেকে ডিমের কুসুম না খেয়ে সাদা অংশ খান এতে তারা ডিমের পরিপূর্ণ পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এর আগে সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয় যা পল্টন মোড় ঘুরে সিরডাপ মিলনায়তনে এসে শেষ হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়-বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষ্যে সবক’টি বিভাগীয় শহরে পোল্ট্রি শোভাযাত্রা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বেশকিছু জেলা শহর এবং উপজেলা সদরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও পেশাজীবী সংগঠনের সহযোগিতায় ডিম দিবস উদযাপিত হচ্ছে।
ঢাকায় শুক্রবার সারাদিন ঘুরে ঘুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, কারওয়ান বাজার, মিরপুর এবং ধানমন্ডিস্থ রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের মাঝে বিনামূল্যে ৩০ হাজার সিদ্ধ ডিম বিতরণ করা হবে। এস.ও.এস শিশু পল্লী, স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানা, ঢাকা অরফানেজ সোসাইটি’র শিশুদের জন্য এবং প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সদস্যদের জন্য বিনামূল্যে ১৫ হাজার ডিম দেয়া হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় এক লাখ পোষ্টার লাগানো হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন বাজারে ডিম বিক্রেতাদের মাঝে টি-শার্ট বিতরণ করা হয়েছে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন