বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট সম্প্রতি উদ্ভাবন করে রাম্বুটানের একটি নতুন জাত, বারি রাম্বুটান-১ নিয়ে আলোচনা করবে আধুনিক পদ্ধতিতে রাম্বুটান চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত।
রাম্বুটান বেশ আকর্ষণীয় ও অনেক সুস্বাদু একটি ফল। এর জন্মস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে। এছাড়াও দক্ষিণ চীন, ইন্দোচীন, ফিলিপাইনের সর্বত্র এটিকে পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে এর সফলভাবে চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া এই ফলের জন্যে অনুকূল তাপমাত্রাবিশিষ্ট। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহ যেখানে শীতের প্রকোপ কম, সেইসব এলাকা রাম্বুটান চাষের উপযোগী।
ফলটি দেখতে লিচুর মতো, আমাদের লিচুর গায়ে কন্টক বিশিষ্ট হলেও রাম্বুটানের গায়ে দাড়িসদৃশ অংশ বিদ্যমান। তাই একে আমাদের দেশে অনেকে চুলওয়ালা লিচু বা দাড়িওয়ালা লিচুও বলে থাকেন। ফল সাদা, স্বচ্ছ, অম্লীয় মিষ্টি গন্ধযুক্ত শাঁস এই ফলের ভক্ষনযোগ্য অংশ।
রাম্বুটানের পুষ্টিমান
রাম্বুটান শর্করা ও ভিটামিনে ভরপুর একটি ফল। ১০০ গ্রাম ফলে জলীয় অংশ ৮২.১ ভাগ, প্রোটিন ০.৯ ভাগ, ফ্যাট ০.১ ভাগ এবং আশঁ ০.০৩ ভাগ। এছাড়া ২.৮ গ্রাম গ্লুকোজ, ৩ গ্রাম ফ্রুক্টোজ, ৯.৯ গ্রাম সুক্রোজ, ২.৮ গ্রাম ফাইবার, ০.০৫ ভাগ ম্যালিক এসিড, ০.৩১ ভাগ সাইট্রিক এসিড, ৭০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ১৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.১-২.৫ মিলিগ্রাম লৌহ, ১৪০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম ও ১০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম বিদ্যমান।
রাম্বুটানের জাত
অনেক জাতের সুস্বাদু রাম্বুটানের চাষ হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট সম্প্রতি উদ্ভাবন করে রাম্বুটানের একটি নতুন জাত, বারি রাম্বুটান-১। এর গাছ বড় আকৃতির হয়ে থাক ও ঝোপবিশিষ্ট। পাকা ফলের রঙ লালচে খয়েরি ধরণের। লম্বা কাঁটা বিদ্যমান ও বেশ লম্বা প্রকৃতির। মাংসল শাঁস, সাদা, নরম, রসালো গন্ধযুক্ত এবং মিষ্টি। এর ভক্ষণ উপযোগী অংশ প্রায় ৫৮ ভাগ।
এই গাছে ফুল আসে বসন্তে, এবং ফল ধরে বৈশাখের পূর্বে থেকেই। শ্রাবণ মাসে ফল সংগ্রহ করা যায়। এটি বাংলাদেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী। আরও পড়ুন করোসল চাষপদ্ধতি।
জলবায়ু ও মাটি
উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া রাম্বুটানের উপযোগী। ২২ থেকে ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা এই গাছের জন্যে সর্বোত্তম। এটেল দোঁ-আশ মাটি রাম্বুটান চাষ উপযোগী। তবে অবশ্যই মাটি সুনিষ্কাশিত ধরণের হতে হবে। জলাবদ্ধতায় গাছ মারা যায়। উচ্চ জৈব উপাদান সমৃদ্ধ হলে গাছের মূলের বৃদ্ধি ও বিকাশ সহজতর হয়।
রাম্বুটানের বংশ বিস্তার
অঙ্গজ ও বীজ উভয়ভাবেই রাম্বুটান বেড়ে উঠতে পারে সহজে। তবে মাতৃ উদ্ভিদের গুণাগুণ বজায় রাখতে অঙ্গজ উপায়ে কলম করাই শ্রেয়। অঙ্গজ উপায়ে মূলত তিনভাবে বিস্তার ঘটানো হয়।
১. কুঁড়ি সংযোজন,
২. বায়বীয় দাবা কলম ও
৩. সংযুক্ত দাবা কলম পদ্ধতি।
১-২ বৎসরের শাখা থেকে সুপ্ত কুড়ি সংগ্রহ করে ৮-১২ মাস বয়সী রুটস্টকে সংযোজন ঘটালে ভাল ফলন পাওয়া যায়। সংযুখ দাবা কলমে সফলতার হার অধিক।
চাষের জমি তৈরি
রাম্বুটানের জন্যে এটেল দোঁ-আশ এবং সুনিষ্কাশিত উঁচু ধরণের জমি নির্বাচন করতে হয়। এই ফলের জন্যে মাদা তৈরি করতে হয়।
রোপণের সময়
মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
রোপণ পদ্ধতি
সমতল ভূমিতে বর্গাকার কিংবা ষড়ভূজাকার পদ্ধতিতে কলম রোপণ করতে হয়। পাহাড়ি জমি হলে কন্টুর পদ্ধতিতে করতে হবে।
রাম্বুটানের জন্য মাদা তৈরি
প্রতিটি গাছের জন্যে কমপক্ষে ৮ মিটার দূরত্ব রেখে কলম করতে হবে। গর্তের সাইজ হবে ১ মিx ১ মি x ১ মি। কলম বা চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে উপযুক্ত পরিমাণে জৈব সার দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। এক্ষেত্রে ২৫-৩০ কেজি গোবর, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০ গ্রাম এমওপি, ২০০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০ গ্রাম জিং সালফেট ভালভাবে মিশিয়ে গর্তে ভরাট করতে হবে। মাটি শুষ্ক হয়ে গেলে পানি সেচ দিতে হবে। এভোক্যাডো চাষের সম্ভাবনা জানুন।
সার প্রয়োগের নিয়মাবলী
গাছ বৃধিকালীন ও ফলনকালীন অবস্থায় নিয়মিতভাবে উপযুক্ত পরিমাণের সার প্রয়োগ করতে হয়। নিচে একটি চার্ট দেওয়া হল-
১. ১-২ বছর – গোবর সার ১০-১৫ কেজি – ইউরিয়া ২০০ গ্রাম – টিএসপি ২৫০ গ্রাম – এমওপি ১৫০ গ্রাম
২. ২-৪ বছর – গোবর সার ১৫-২০ কেজি – ইউরিয়া ৩০০ গ্রাম – টিএসপি ৪৫০ গ্রাম – এমওপি ৩০০ গ্রাম
৩. ৫-৭ বছর – গোবর সার ২০-২৫ কেজি – ইউরিয়া ৪৫০ গ্রাম – টিএসপি ৭৫০ গ্রাম – এমওপি ৪৫০ গ্রাম
৪. ৮-১০ বছর – গোবর সার ২৫-৩০ কেজি – ইউরিয়া ৭৫০ গ্রাম – টিএসপি ১২০০ গ্রাম – এমওপি ৬০০০ গ্রাম
৫. ১০-১৫ বছর – গোবর সার ৩০-৪০ কেজি – ইউরিয়া ১২০০ গ্রাম – টিএসপি ১৫৫০ গ্রাম – এমওপি ৭৫০ গ্রাম
৬. ১৫ বছরের উর্ধ্বে – গোবর সার ৪০-৫০ কেজি – ইউরিয়া ১৫০০ গ্রাম – টিএসপি ২০০০ গ্রাম – এমওপি ১০০০ গ্রাম
উল্লিখিত পরিমাণের সার তিনকিস্তিতে প্রদান করতে হবে। প্রথম কিস্তি ফল সংগ্রহের শেষে বা ভাদ্র মাসে, দ্বিতীয় কিস্তি শীতের শুরুতে ও শেষ কিস্তি গাছে ফল আসার পর অর্থাৎ বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসের দিকে।
আন্তঃপরিচর্যা
আগাছা দমন
গাছের উপযুক্ত বিকাশ ও সর্বোচ্চ ফল পাওয়ার জন্যে নিয়মিতভাবে আগাছা দমন করতে হবে। প্রতি মাসে একনার গাছেত চারপাশে কুপিয়ে দিতে হবে। উলুঘাস জাতীয় আগাছা গাছের আশেপাশে বাড়তে দেওয়া যাবে না।
পানি সেচ
রাম্বুটান খরা সংবেদনশীল উদ্ভিদ। নিয়মিত পানি প্রদান না করলে গাছ মরে যেতে পারে। আবার গাছের গোড়ায় পানি জমা থাকা যাবে না। শুকনো মৌসুম বিশেষত শীতকালে ১০-১৫ দিন পরপর পানি সেচ দিতে হবে। গাছে কুঁড়ি দেখা দিলে একবার, ফল মটরদানার মতো বাড়লে একবার ও ১৫ দিন আরও একবার অত্যাবশ্যকীয় ভাবে পানি দিতে হবে। নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত মাটি ব্যবহার করতে হবে যেন বর্ষায় গাছের গোড়ায় পানি না জমে। আরও বিস্তারিত জানুন প্যাশন বা ট্যাং ফল নিয়ে।
ডাল ছাঁটাই
ডাল ছাঁটাই না করলে রাম্বুটান গাছ লম্বা খাড়াভাবে বেড়ে উঠবে। এজন্যে গাছের আগা একটু বৃদ্ধি পেলেই ছেঁটে দিতে হবে। যেন প্রসারণে গাছের বৃদ্ধি হয় ও ঝোপ তৈরি করে। ফল সংগ্রহের পর ফুলের মুকুল গোড়া থেকে কেটে দিতে হবে, তাতে নতুন কুঁড়ি দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
ফল সংগ্রহ
আমাদের দেশে শ্রাবণ মাসে এই ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়ে যায়। সাধারণত ফলের রঙ লালচে বর্ণ ধারণ করলেই ফল সংগ্রহ করা শুরু করতে হবে। উপযুক্ত বাজারমূল্য পেতে ফল লালচে-খয়েরি বর্ণ ধারণ করার ১০-১২ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করে নিতে হবে। ফল পেড়ে আনার পর বেশিদিন ভাল থাকে না, খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই অল্প দিনের মধ্যেই খেয়ে ফেলতে হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৭জুন২০