আনারস অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। টিনজাত খাদ্য হিসেবে আনারস সংরক্ষণ করা যায়। আনারস দিয়ে জ্যাম, জেলি ও জুস তৈরি করা যায়। আনারস চাষ করে পারিবারিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয় করা সম্ভব। এছাড়া দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।
মাটির প্রকৃতি ও জলবায়ু
দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি আনারস চাষের জন্য বেশি উপযোগী। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি থেকে অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি সময়ে আনারসের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে সেচ সুবিধা থাকলে মাঘ মাসের মাঝামাঝি থেকে ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময়েও চারা লাগানো যায়।
জাত
১. হানিকুইন: পাকা আনারসের শাঁস হলুদ বর্ণের হয়। চোখ সূঁচালো ও উন্নত। গড় ওজন প্রায় এক কেজি। পাতা কাঁটাযুক্ত ও পাটল বর্ণের। হানিকুইন বেশ মিষ্টি আনারস।
২. জায়েন্ট কিউ: পাকা আনারস সবুজাভ ও শাঁস হালকা হলুদ, চোখ প্রশস্ত ও চেপ্টা। গড় ওজন প্রায় দুই কেজি। গাছের পাতা সবুজ ও প্রায় কাঁটাবিহীন।
৩. ঘোড়াশাল: পাকা আনারস লালচে এবং ঘিয়ে সাদা রঙের হয়। চোখ প্রশস্ত। গড় ওজন প্রায় সোয়া কেজি। পাতা কাঁটাযুক্ত, চওড়া ও ঢেউ খেলানো থাকে।
বংশ বিস্তার
স্বাভাবিক অবস্থায় আনারসের বীজ হয় না। তাই বিভিন্ন ধরণের চারার মাধ্যমে আনারসের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। সাধারণত পার্শ্ব চারা, বোঁটার চারা, মুকুট চারা ও গুঁড়ি চারা দিয়ে আনারসের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। এর মধ্যে পার্শ্ব চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো।
জমি তৈরি
১. মাটি ঝরঝরে করে চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল করে নিতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি কোন স্থানে জমে না থাকতে পারে।
২. জমি থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু এবং এক মিটার প্রশস্ত বেড তৈরি করতে হবে।
৩. এক বেড থেকে অপর বেডের মধ্যে ৫০ থেকে ১শ’ সেন্টিমিটার দূরত্ব রাখতে হবে।
চারা রোপণ পদ্ধতি
১. এক মিটার প্রশস্ত বেডে দুই সারিতে চারা রোপণ করতে হবে।
২. সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০ খেকে ৪০ সেন্টিমিটার রাখতে হবে।
সার প্রয়োগ
গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে আনারস চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশেপাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদির স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সেচ ও নিষ্কাশন
* শুকনা মৌসুমে আনারস ক্ষেতে সেচ দেওয়া খুবই প্রয়োজন।
* বর্ষা মৌসুমে বেশি বৃষ্টির সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেজন্য নালা কেটে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগবালাই ও তার প্রতিকার
আনারস চাষের জমিতে পোকার আক্রমণ হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চাষের সময়ের পরিচর্যা
১. চারা বেশি লম্বা হলে ৩০ সেন্টিমিটার পরিমাণ রেখে আগার পাতা সমান করে কেটে দিতে হবে।
২. আনারসের জমি সর্বদা আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
রোগবালাই ও তা দমনে করণীয়
আমাদের দেশে প্রতি বছর ১৫-২০ হাজার হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয় এবং ১৫০-২০০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। অনেক সময় সঠিক পরিচর্যার অভাব, ছত্রাক ও পোকামাকড়ের আক্রমণসহ নানা কারণে প্রতি বছর আনারস চাষিরা ব্যাপক পরিমাণ ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তাই ক্ষতিগ্রস্ত আনারস চাষিদের জন্য এই সমস্যার সমাধানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হল:
ফল পচা : সেরাটোসাইটিস প্যারাডোসা (Ceratocystis paradoxa) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা আনারস এ পচন ধরে। ফলে এর প্রভাবে উৎপাদন শূন্যের কাছাকাছি আসতে পারে।রোগের লক্ষণ :
(ক) ফলের ওপর পানি ভেজা দাগ পড়ে পরে তা হলুদ হয়ে গাঢ় বাদামি ও কালচে রঙ ধারণ করে।
(খ) আক্রান্ত অংশের টিসু (কোষ) নরম হয়ে পচে যায়।
(গ) পাকা ফল আক্রান্ত হলে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গন্ধ পাওয়া যায়।
(ঘ) পাতা আক্রান্ত হলে সম্পূর্ণ গাছ কালো হয়ে পচে যায়।
দমন ব্যবস্থা :
১. বাগান পরিষ্কার রাখতে হবে।
২. রোপণ দ্রব্য রোগ প্রতিরোধী জাতের সাকার ব্যবহার করতে হবে।
৩. রোপণের আগে সাকার দুই ঘণ্টা হালকা রোদে শুকিয়ে নিলে এ রোগের সম্ভাবনা কম থাকে।
৪. সংগ্রহকৃত আনারস প্যাকিংয়ের আগে ঝুড়িকে ৩ শতাংশ ফরমালিন দিয়ে রোগমুক্ত করতে হবে।
৫. ফলের কর্তিত অংশের গোড়ায় ১০ শতাংশ বেনজোইক অ্যাসিড দ্রবণে ডুবিয়ে নিতে হবে।
কাণ্ড পচা (Stem rot) :
এ রোগ ফাইটোপথোরা প্যারাসাইটিকা (Phytophthora parasitica) নামক এক প্রকার ছত্রাক দিয়ে হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ :
(ক) প্রথমে পাতা হলুদ ও পরে বাদামি হয়ে যায়।
(খ) কাণ্ডের গোড়ার অংশ ও মূল কাল বর্ণ ধারণ করে পচতে শুরু করে।
(গ) একপর্যায়ে সম্পূর্ণ গাছ মরে যায়।
দমন ব্যবস্থা :
১. বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
২. রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে।
৩. বাগানে যেন পানি না জমে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. রোগ প্রতিরোধে রোপণের আগে ৪:৪:৫০ অনুপাতে বোর্দোমিক্সচার দ্রবণে চারা ডুবিয়ে নিতে হবে।
পোকামাকড় দমন :
ছাতরা পোকা বা মিলিবাগ :
(ক) এ পোকা গাছের পাতা, কাণ্ড, ফল প্রভৃতি থেকে রস চুষে খেয়ে সেখানে ক্ষত সৃষ্টি করে।
(খ) মূল বা কাণ্ড ও মূলের সংযোগস্থলে আক্রমণ হলে গাছ নেতিয়ে পড়ে।
(গ) ফল আক্রান্ত হলে পচে যায়।
(ঘ) আক্রান্ত স্থান দিয়ে ভাইরাস ঢুকে অ্যানাসা উইল্ট রোগ সৃষ্টি করে।
দমন ব্যবস্থা :
১. রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে (যেমন কুইন, পানামবুকো, স্প্যানিশ প্রভৃতি)।
২. ফল সংগ্রহ করার পর শুকনো লতাপাতা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৩. ম্যাথিয়ন-৫৭ ইসি ৮ সিসি ২ দশমিক ৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৯জুন২০