শসা আমাদের দেশে জনপ্রিয় একটি সবজি। শসা শুধু সালাত হিসেবে নয় সবজি হিসেবেও খাওয়া যায়। শসার মধ্যে অধিকাংশ থাকে পানি। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, শসার প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে ৯৬% জলীয় অংশ, ০.৬ গ্রাম আমিষ, ২.৬ গ্রাম শ্বেতসার, ১৮ মিঃ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.২ মিঃ গ্রাম লৌহ, ক্যারোটিন ৪০ মাইক্রোগ্রাম, খাদ্যপ্রাণ সি ১০ মিঃ গ্রাম রয়েছে। আমাদের দেশে শসা সালাদ তালিকার প্রথম রাখা হয়। এছাড়াও শসা রূপ চর্চার জন্যও ব্যবহার করা হয়। শসা ও খিরা খেতে প্রায় একই রকম হলেও দুটি একটু আলাদা। আসুন জেনে নেই শসার চাষ পদ্ধতি।
শসা চাষে জলবায়ু ও মাটি: শসা উৎপাদনের জন্য উর্বর দো-আঁশ মাটি হলে ভাল হয়। শসা সারা বছর হলেও ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার মধ্যে ভালো হয়। অধিক তাপমাত্রা, দীর্ঘ দিবস ও প্রখর আলোত বেশি পুরুষ ফুল উৎপন্ন হয়।
শসার জাত: আমদের দেশে বিভিন্ন জাতের শসার চাষ হয়ে থাকে। যেমন- বারোমাসি , পটিয়া জায়ান্ট, শিলা, আলাভী, বীরশ্রেষ্ঠ , শীতল, হিমেল, গ্রীন ফিল্ড, পান্ডা, ভেনাস, মাতসুরি, বাশখালী, মধুমতি, নওগা গ্রীন, লাকী ৭ ইত্যাদি। বেশির ভাগই চাষ করা হয় হাইব্রিড জাতের শসা। বর্তমানে আমাদের দেশে হাইব্রিড জাতের অনেক শসা বাজারে পাওয়া যায়।
জীবনকাল: শসার জীবন কাল সাধারণত জাত ভেদে ৩ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত। সময় ঃ বাংলাদেশে শসার বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ফেব্র“য়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত।
চারা উৎপাদন: নার্সারী বা বীজ তলায় চারা তৈরী করে জমিতে লাগানো যায়। শসার বীজ জমিতে বেড তৈরী করে বা পলিথিনের ছোট প্যাকেটে বপন করা যায়। যেভাবেই চারা উৎপাদন করা হোক না কেন আগে মাটিতে জৈব সার মিশিয়ে নিতে হবে। চারা লাগানোর ক্ষেত্রে আলাদাভাবে শসার চারা তৈরি করে নিতে হবে। ভালো জাতের বীজ নির্বাচন করতে হবে। বীজ বপনের ২৪ ঘণ্টা আগে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পলিব্যাগে, কলার খোলে বা বেড তৈরি করে চারা তৈরি করে নেয়া যায়। প্রতি মাদায় ৪-৫ টি বীজ পুঁতে দিতে হবে। তবে মনে রাখবেন পলিব্যাগে চারা তৈরি করা নিরাপদ। এক্ষেত্রে অর্ধেক গোবর ও অর্ধেক মাটি পলিব্যাগে ভরতে হবে। এরপর উক্ত মাটি দ্বারা পলিব্যাগ ভরতে হবে। পলিব্যাগের মাটি ভরাট করার পরে রেখে দিতে হবে। এবং উপরে ছাউনি দিয়ে দিতে হবে। যাতে রোদ, বৃষ্টি না লাগে। মাঝেমধ্যে পলিব্যাগের মধ্যে ঝাঁঝরি দিয়ে পানি সেচ দিয়ে পলিব্যাগের মাটিতে চারা লাগানোর জো আনতে হবে। এরপর প্রতিটি ব্যাগে ২ থেকে ৩ টি চারা রোপন করতে হবে। চার দুপাতা হলে প্রতি পলিব্যাগে একটি করে চারা রেখে বাকি চার তুলে ফেলতে হবে। শসা আকৃতিতে লম্বা হয়। শসা প্রায় ৮/১০ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। শসার গায়ের রঙ সবুজ। তবে পাকলে হলুদ রঙের হয়। ভেতরে সাদাটে সবুজ রঙের এবং মধ্যভাগে বিচি থাকে।
চাষের উপযুক্ত জমি তৈরি ও চারা রোপন: শসা গাছের চার লাগানোর পূর্বে ৩-৪ বার গভীর চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। আগাছামুক্ত ঝুরঝুরা করে নিতে হবে। চাষের সময় জমিতে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেসব জমি উঁচু ও বর্ষার পানি আটকে থাকে না এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। শসার চাষ করে ক্ষেত্রে বেড তৈরি করে দিতে হবে। এবং প্রতি বেডের মাঝে সারি করে ২ মিটার দূরে দূরে সবদিকে ৫০ সেন্টিমিটার মাপে গর্ত করে মাদা তৈরি করতে হবে। মাদা তৈরি করে সেখানে সরাসরি দুইটি করে বীজ বুনে দেওয়া যায়। ফেব্র“য়ারি থেকে মার্চ মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। হেক্টর প্রতি ৩ থেকে ৪ কেজি বা শতক প্রতি ১২ থেকে ১৫ গ্রাম বীজ লাগে। বীজের আঁকারের দ্বিগুণ গভীরে বীজ বপন করা ভাল। পলিব্যাগ থেকে চারা অপসারনের সময় পলিব্যাগে পানি সেচ দিতে হবে। তাহলে চারা অপসারনের সময় চারার শেকড় ভেঙে বের হবে না বা নষ্ট হবে না। বিকেলবেলা চারা রোপন করতে হবে এতে চারা কম মরে। চারা লাগানোর পরে চারার গোঁড়াা মাটি দিয়ে টিপে দিতে হবে। এরপর পানি সেচ দিতে হবে।
শসা চাষে সার প্রয়োগ/ব্যবস্থাপনা: শসার বেশি ফলন ও গাছের বৃদ্ধির জন্য নিয়মমতো সার দিতে হবে। প্রতি মাদায় পচা গোবর, ছাই, পচা কচুরিপানা, জৈব সার ইত্যাদি মিলিয়ে ৫-৬ কেজি, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ৬০-৭০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করে মাটিতে ভালোমতো মিশিয়ে দিতে হবে। ১৫-২০ দিন পর পর প্রতি মাদায় ৫০ গ্রাম হারে ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও পানি নিষ্কাশন: শসা পানির প্রতি খুব সংবেদশীল। মাটিতে রস কম থাকলেই সেচ দেয়া প্রয়োজন। তবে ইউরিয়া উপরি প্রয়োগের পর সেচ দেয়া উত্তম। খেয়াল রাখবেন শসা গাছের মাটি শুকিয়ে গেলে ফুল ঝরে যায় এবং গাছ ঢলে আসে। আবার বর্ষাকালে ক্ষেতে পানি জমে থাকলেও শসার জন্য ক্ষতিকর। বৃষ্টি বেশি হলে সেচ দেয়ার দরকার নেই। কয়েকদিন পানি জমে থাকলেই গাছের গোঁড়া পচে মরে যেতে পারে। সেজন্য নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
আগাছা ও নিড়ানি: জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। প্রতিবার ইউরিয়া সার দেয়ার পর আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছ লতানোর জন্য মাচার ব্যবস্থা করতে হবে। গাছ একটু বড় হলেই মাচা তৈরি করে দিতে হবে। রোগবালাই দমনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখবেন শসা গাছ বিভিন্ন রোগের আশ্রয়দাতা। তাই ক্ষেত সবসম্য আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগদমন ঃ ডাউনি মিলডিউ শসার সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগ। এ রোগ হলে পাতার নিচে প্রথমে জলবসা গোল গোল দাগ পড়ে। পরে দাগগুলো শুকিয়ে বাদামি হয় ও ওপরে উঠে আসে। শেষে পুরো পাতাই শুকিয়ে ফেলে। এই রোগ হলে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। ফলের মাছি কচি শসা নষ্ট করে। ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রনের জন্য জমিতে বিষ টোপ বা সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ পাততে হবে। বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ শুরু করা যায়। খাওয়ার জন্য কচি থাকতেই সবুজ রঙের শসা তুলতে হবে। হেক্টর প্রতি ১০ থেকে ২০ টন অর্থাৎ শতক প্রতি ৪০ থেকে ৮০ কেজি শসা তোলা যায়।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১২মে২০