ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা কিছুটা পিছিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে মৎস্য বিভাগ। এবার নদ-নদীতে ইলিশ কম আসায় জেলেরা যাতে আরও কয়েক দিন ইলিশ ধরার সময় পান, সে জন্য বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ নিষেধাজ্ঞার সময় পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে মাঠপর্যায়ের ক্ষুদ্র জেলেরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পেছানোটা হবে আত্মঘাতী।
মৎস্য বিভাগ বলছে, এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সব পক্ষের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে। নিষেধাজ্ঞার দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার গত রোববার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, এবার নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে এটা চূড়ান্ত হয়নি।
মৎস্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, এবার যেহেতু নদ-নদীতে ইলিশের সংকট চলছে। তাই শেষ মুহূর্তে ইলিশ পাওয়া যেতে পারে—এমন সম্ভাবনা মাথায় রেখে এবার ২০ অক্টোবর পূর্ণিমা তিথি শুরুর চার দিন আগে থেকে নিষেধাজ্ঞা শুরুর সম্ভাবনা বেশি। এ রকম মতামতও অধিদপ্তরের মাঠপর্যায় থেকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জেলেরা বলছেন, ৬ অক্টোবরে অমাবস্যায় প্রচুর ইলিশ নদ-নদীতে ছুটে আসবেই। তাই এই অমাবস্যাকে সামনে রেখে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু করা না গেলে সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ নদীতে ফেরার পথে মারা পড়বে। ইলিশের প্রজনন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এ জন্য ৬–২০ অক্টোবর পূর্ণিমা ধরেই এই নিষেধাজ্ঞা সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে।
মাঠপর্যায়ে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে দুই রকমের মত পাওয়া গেছে। নদ-নদীতে যেসব ছোট ও প্রান্তিক জেলে মাছ ধরেন তাঁরা বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিলে সেটা হবে আত্মঘাতী। এতে ছোট ও প্রান্তিক জেলেদের কোনো লাভ হবে না। লাভবান হবে গভীর সাগরে মাছ ধরে এমন বড় ট্রলার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারগুলোর মালিকের। কারণ, সরকার ২২ দিন যে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারণ করেছে সেটাই আসলে প্রজননের উৎকৃষ্ট সময়। এই সময়সীমা পিছিয়ে দিলে গভীর সাগর থেকে নদীতে ফেরা মাছেরা বড় ট্রলারের জেলেদের জালে ব্যাপক হারে আটকা পড়বে। তাতে ইলিশের উৎপাদনে বড় ধরনের ধস নামবে।
বরগুনার তালতলী উপজেলার জেলে দুলাল মিয়া বলেন, ‘আশ্বিনা পূন্নিমা-আমবইস্যায়ই ইলশা মাছের ডিম ছাড়নের সময়। হেই সময় যদি অবরোধ না দেয় তাইলে এহন যে দু-চাইরডা ইলশা গাঙ্গে পাই আগামীতে হেইয়্যাও থাকপে না। সব বড় ট্রলারের জালে আটকা পড়বে।’
জেলে দুলাল মিয়ার কথার সত্যতা মেলে বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাসের কথাতেও। তিনি রোববার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ইলিশ সারা বছরই ডিম দেয়। কিন্তু অধিকাংশ ডিম দেয় সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের চারটি অমাবস্যা-পূর্ণিমায়। সবচেয়ে বেশি দেয় অক্টোবরে। এরই মধ্যে আমরা গবেষণা চালিয়ে দেখেছি সেপ্টেম্বরের একটি পূর্ণিমায় এক ভাগ ইলিশ ডিম ছেড়েছে। তিনি আরও বলেন, মূলত অক্টোবরে ভরা অমাবস্যা ও পূর্ণিমাকে ধরেই প্রতিবছর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এবার ৬–২০ অক্টোবরের মধ্যে অমাবস্যা-পূর্ণিমা হবে।
নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ পেছানোর বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁদপুরে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশবিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেছানোর বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে। তাই এ নিয়ে এখনই মতামত দিতে চাচ্ছি না।’
ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে বেশ কয়েক বছর ধরে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। এই সময় মাছ ধরা, বিক্রি, বিপণন, মজুত ও পরিবহন নিষিদ্ধ থাকে। এর লঙ্ঘন করা হলে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশে ২০০৩-২০০৪ সাল থেকেই জাটকা রক্ষার কর্মসূচি শুরু করা হয়। তখন থেকেই ধীরে ধীরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছিল। ২০০৮ সাল থেকে প্রথম আশ্বিন মাসে পূর্ণিমার আগে ও পরে মিলিয়ে ১১ দিন মা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তখন থেকেই এর সুফল দেখতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। তখন তাঁরা গবেষণায় দেখতে পান, শুধু পূর্ণিমায় নয়, এই সময়ের অমাবস্যাতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে। পরে পূর্ণিমার সঙ্গে অমাবস্যা মিলিয়ে টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া শুরু হয়। গত অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। এর ৬৬ ভাগ এসেছে বরিশাল বিভাগের জেলাগুলো থেকে। এই পরিমাণ তিন লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১