জাহিদ রিপন, পটুয়াখালী থেকে: প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি জমি, বাড়ছে মানুষ। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান দিতে কৃষি জমির উপর বাড়ছে চাপ। খাদ্য এবং শস্য উৎপাদনের এই বাড়তি চাপে সোনালী আশ-পাটের আবাদ চলে গেছে প্রান্তিক জমিতে। ফলে একসময় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাট অন্যতম থাকলেও কালক্রমে সেই পাটের চলছে এখন দুর্দিন।
পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনাসহ উন্নত জাতের পাট অতিদ্রত কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকার নিয়েছে ব্যাপক উদ্যোগ। আর এ নিয়ে নিরলস কাজ করছেন দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা। উদ্ভাবন করেছেন লবণাক্ততা সহনশীল পাটের জাত। আর এ জাতের পাটের চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে চরাঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমিতে।
একসময় জেলার উপকূলীয় সর্বত্র ব্যাপক পাটের আবাদ হত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানির প্লাবনে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় পাটের আবাদ উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। তবে এখন তোষা জাতের ছড়ানো-ছিটানো কিছু পাটের আবাদ হয়। যা শুধু শাক হিসেবে খাওয়ার জন্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে পাটের আবাদ নেই। অথচ চরাঞ্চলের পতিত লবণাক্ত জমিতে অর্থকরী ফসল পাট আবাদের মাধ্যমে একটি বাড়তি ফসল ফলানোর সুযোগ রয়েছে। সোনালী আঁশ পাট আবাদের মাধ্যমে কৃষকের আর্থিক লাভবান হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা।
দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় ১৮টি জেলায় রয়েছে প্রায় ১.০৬ মিলিয়ন হেক্টর পতিত লবণাক্ত জমি। যার মধ্যে উপকূলীয় পটুয়াখালী জেলায় রয়েছে ১,৫৫,১৮০ হেক্টর চরাঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমি। এসব পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনতে লবণসহিষ্ণু জাতের পাটের আবাদের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
কৃষকদের পাট চাষে আগ্রহী করে তোলার পাশপাশি পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনতে ২০০১ সালে জেলার কলাপাড়ার পাখিমারায় গড়ে তোলা হয় পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। কুয়াকাটাগামী মহাসড়ক লাগোয়া প্রায় ১০ একর জমির উপরে প্রতিষ্ঠিত পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভেতরে রয়েছে আবাদ করা বিভিন্ন জাতের পাটের ক্ষেত, গবেষণা প্লট, বীজ উদ্ভাবন প্লট, পচন প্রক্রিয়ার চৌবাচ্চা। চলছে গবেষণা কার্যক্রম।
পাটকে অন্যান্য ফসলের সাথে অন্তর্ভুক্ত করে উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি উপযোগী শস্যবিন্যাস প্রবর্তন, শীতকালীন সবজির সাথে পাট বীজ উৎপাদন, অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ফসলের লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন গবেষণা কার্যক্রম চলছে এখানে। এখানে গবেষণা চালিয়ে পাটের উচ্চ লবণাক্ত সহিষ্ণু জাতের (৯ ডেসি চ/স) ও (১৪ ডেসি চ/স) চারটি লাইন উদ্ভাবন করেছেন কৃষিবিদ ড. মাহমুদ আল হোসেন। যা ইতোমধ্যে জাতীয় বীজ বোর্ডের সভায় অনুমোদন পেয়েছে।
সফল এই কৃষিবিদ পরীক্ষামূলকভাবে উপকূলীয় এলাকার চাষিদের পতিত জমিতে আবাদ করেছেন তার উদ্ভাবিত জাতের পাট প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের পতিত জমিতে চাষে উদ্ভুদ্ব করেছেন।
২০১৫ সালের এপ্রিল-মে মাসে পরীক্ষামূলকভাবে পাঁচটি ইউনিয়নের ২৫০ চাষীর ২৫ হেক্টর পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের পাট চাষ করা হয়। কৃষক পর্যায়ে পাটের আবাদের এমন উদ্যোগ নেয়ায় কৃষকের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। পাট গবেষনা কেন্দ্রের নিয়মিত তদারকি এবং সহযোগিতায় কৃষকরা পেয়েছেন পাট চাষে আশাতিরিক্ত সাফল্য। এখন কৃষকরা জমিকে পতিত না ফেলে পাট চাষে হয়েছেন আশাবাদী।
বাণিজ্যিকভাবে পাটের উৎপাদনের জন্য বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন আর সরকারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে জেলার গোটা উপকূলের পতিত লবনাক্ত জমি পাট চাষের আওতায় এনে, কৃষকের অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানোর উজ্জল সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করলেন পাট গবেষনা ইনস্টিউট’র পাট বিজ্ঞানী ড.মাহমুদ আল হোসেন।
লবণাক্ত জমিতে পাট উৎপাদনের প্রযুক্তি তথ্য, লবণ সহিষ্ণু একটি জাত এবং চারটি লাইন উদ্ভাবনের পরে এবারে পাট বীজ উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।
লবণ সহিষ্ণু পাটের জাত উদ্ভাবক ড. মাহমুদ আল হোসেন বলেন, এ জাতের পাটের উদ্ভাবনের পরে ২০১৫ সাল থেকে বীজ উৎপাদনের গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয়। যা সফল হয়েছে। ফলে কৃষকের যে পরিমান পাট বীজ দরকার হবে তা নিজেই উৎপাদন করতে পারবে। দক্ষিণাঞ্চলের কলাপাড়াসহ ৬টি উপকূলীয় এলাকায় পাট চাষে এমন সফলতা পাওয়া গেছে।
ড. মাহমুদ আরো বলেন, কৃষকরা পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের লবণাক্ত জমিতে পাট উৎপাদনের প্রযুক্তি তথ্য বাস্তবে দেখেন এবং শেখেন। পরিদর্শন করেন বিভিন্ন প্রদর্শনী মাঠ। এতে কৃষকরা তাদের সোনালী আশ আবাদে ফের মাঠে ঝুকে পড়েছেন। আগ্রহী কৃষকদের পাট চাষের জন্য বীজের পাশাপাশি বিভিন্ন উপকরন বিনামূল্যে দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন