বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এখন প্রচুর বৃস্টি।এ সময় পোল্ট্রি খামারিদের নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক নিয়মেই সময়টাতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হয় বলে একটানা ও থেমে থেমে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি, দেশের কোনো কোনো অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত, কোথাও ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, কোথাও বা থেমে থেমে দীর্ঘদিন বৃষ্টির কারণে অনেক সময় সঠিক খামার ব্যবস্থাপনা হুমকির সম্মুখীন হয়। এই অবস্থায় নিন্মোক্ত ব্যবস্থাগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখলে খামারি উপকৃত হবে-
পোল্ট্রি খামারে করণীয়:
১. পোল্ট্রি শেডের চারপাশে ৫ মিটার জায়গা অতিরিক্ত বাড়াতে হবে;
২. বাড়তি জায়গা ভালভাবে পরিস্কার এবং ঘাস ও ঝোপঝাড় মুক্ত রাখতে হবে; বাড়তি জায়গার উপরে ভালমত ছাউনি দিতে হবে;
৩. ছাদের যেকোনো ছিদ্র পূর্বেই সারিয়ে নিতে হবে;
৪. প্রয়োজনীয় পলিথিনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে যদি অতিরিক্ত ছাউনি দেওয়া না হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে অতিরিক্ত বৃষ্টির সময় সামনে ও পেছনে যেন চটের তৈরি আচ্ছাদন থাকে। বড় মুরগির ক্ষেত্রে বৃষ্টি না থাকলে তা উঠিয়ে রাখতে হবে যাতে ভালভাবে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে;
৫. বাচ্চা উঠানোর আগেই সকল পাকা মেঝে ভালমত রিপিয়ারিং করতে হবে এবং যতদিন সম্ভব শুষ্ক রাখা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে;
৬. খাবারের পাত্র যাতে যথাসম্ভব শুষ্ক রাখা যায় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে;
৭. লিটারের ক্ষেত্রে, জানালা এবং ঘরের পাশ দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢোকার সম্ভাব্য সব ছিদ্র বের করতে হবে এবং তা বন্ধ করার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন লিটার শুষ্ক থাকে। শক্ত লিটার ভেঙ্গে দিয়ে নতুন লিটার ছড়িয়ে দিয়ে এবং শুষ্ক দ্রব্য যেমন: লাইম পাউডার, এমোনিয়াম সালফেট ইত্যাদি ব্যবহার করে শুষ্ক অবস্থা বজায় রাখতে হবে। অন্যথায় ভেজা লিটার কক্সিডিওসিস, এন্টারইটিস, কৃমি সংক্রমণের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার হবে যা পোল্ট্রির জন্য ক্ষতিকর;
৮. যারা আখের ছোবড়া লিটার হিসেবে ব্যবহার করেন তাদের যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অন্যথায় Aspersillus fumigatus নামক মোল্ড জন্মাতে পারে যা ফুসফুসের কোষে প্রবেশ করে এবং বাচ্চাতে ব্রুডার নিউমোনিয়া ঘটায়।
৯. পোল্ট্রি শেডের আশেপাশে যাতে বৃষ্টির পানি জমে না থাকে সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রয়োজনে পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে বিভিন্ন রোগ-বালাই শেডে প্রবেশ করতে পারে।
খাবার প্রদানে করণীয়: বর্ষার সময় যাতে নতুন খাদ্য কেনা না লাগে এজন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য মজুত করা উচিত। অন্যথায়, পরিবহনের সময় খাদ্য পরিবেশ হতে আর্দ্রতা শোষন করবে। খাদ্য কেনার পর খাদ্যের ব্যাগ কাঠের মাচাতে রাখা উচিত। তবে মাচা যেন মেঝে থেকে এবং দেওয়াল থেকে এক ফুট দূরত্বে থাকে। পাকা ঘরের জন্য খাদ্য সংরক্ষণের রুম থাকা দরকার যা কোনোভাবেই ভেজা না থাকে। যদি ঘরের ভেতরের আর্দ্রতা বেশি থাকে অথবা পানি প্রবেশ করে এবং এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকে তবে ফাংগাস এবং মোল্ডের মারাত্মক সংক্রমণ দেখা দেবে। সবচেয়ে ভয়ংকর যে ফাংগাস ভুট্রা, ফিসমিল ইত্যাদিতে আক্রমণ করে তা হচ্ছে Aspergillus flavus। এই প্রজাতি হতে যে বিষ নিঃসৃত হয় তা আফলাটক্সিন বি ১, বি ২, জি ১, এবং জি ২ নামে পরিচিত। এর মধ্যে বি ১ হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক। এর ফলে ডিম উৎপাতন হ্রাস, বৃদ্ধি ব্যাহত, নিম্ন খাদ্যে রূপান্তর, লিভার টিউমার এমনকি লেয়ার ও ব্রয়লারের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। লেয়ারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ০.১ পিপিএম এবং ব্রয়লারের জন্য ০.০৫ পিপিএম বাস্তব ক্ষেত্রে সহনীয় মাত্রা। হাঁস এবং টার্কি, মুরগির চেয়ে বেশি সহনীয়। এজন্য খাদ্যে ভালমানের টক্সিন বাইন্ডার সাধারণ মানের চেয়ে একটু বেশি ভাল ব্যবহার করা উচিত।
সবদিক বিবেচনা করে একথা বলা যায় যে, বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই ভাল মানের খাদ্য কেনা উচিত। অন্যথায় বিক্রেতার গোডাউনে অধিক আর্দ্রতার কারণে তা অক্সিডাইজড হয়ে যেতে পারে। এমন খাদ্য কিনতে হবে যাতে সঠিক মাত্রার এন্টিঅক্সিডেন্ট যোগ করা থাকে। ফলে খাদ্যের গুণগতমান অক্ষুন্ন থাকবে। বর্ষাকালে ঝিনুকের অভাব দেখা যায়। যেহেতু ঝিনুক সস্তা খাদ্য উপাদান এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় তাই ভাল সিদ্ধান্ত হবে যদি আগেই কিনে মজুদ করা যায়। তবে যে কোনো খাদ্য মজুদের পূর্বেই ঘরের তাপ কি পরিমাণ সংরক্ষণ করা যাবে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। লক্ষ্যণীয় যে, ধারণক্ষমতার চেয়ে অধিক সংরক্ষণ করা যাবে না।
পানির ব্যবস্থাপনা: বর্ষাকালে পুকুর, নদী, টিউবওয়েল এমনকি ট্যাপের পানি পর্যন্ত জীবাণু দ্বারা দূষিত হয় যা প্রাকৃতিকভাবেই মাটিযুক্ত বৃষ্টির পানির মাধ্যমে ঘটে থাকে। একুয়াগার্ড জাতীয় টেবলেট (৫০০ লিটার পানিতে ১ টি) দিয়ে পানি জীবানুমুক্ত করতে হবে। ভাল পানি পেতে হলে এলাম দ্বারা পরিশোধন করে এবং ২৪ ঘণ্টা ধরে অধঃক্ষেপন করতে হবে। পানি বিশুদ্ধ করার অন্য উপায় হচ্ছে ৩৫ ভাগ ক্লোরিন যুক্ত করা যা ২ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার ১০০০ লিটার খাবার পানির সাথে মিশ্রণ করে পাওয়া যায়। এ পানি মিশ্রণের ৩ ঘণ্টা পরে প্রয়োগ করতে হবে।
লিটার ব্যবস্থাপনা: যখন পোল্ট্রিকে ডিপ লিটার পদ্ধতিতে পালন করা হয় তখন তা সবসময় শুষ্ক রাখা উচিত। সাধারণত ২৫ ভাগ আর্দ্রতা থাকে তৈরিকৃত লিটারে। লিটারের অবস্থা বোঝার জন্য একমুঠো লিটার হাতে নিয়ে হালকা চাপ দিয়ে ছেড়ে দিলে যদি লিটার বলের মত আকৃতির না হয় এবং এক সাথে পড়ে তবে বুঝতে হবে লিটারের অবস্থা ভাল। মনে রাখা দরকার, লিটারের অবস্থা ভাল রাখতে হলে সপ্তাহে অন্তত একদিন লিটার নেড়ে দিতে হবে। যদি লিটারের কোনো অংশ ভিজে যায় তবে দ্রুত তা সরিয়ে নতুন শুষ্ক লিটার দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, ভেজা লিটার কক্সিডিওসিস এর মত জীবনঘাতি জীবাণুর বৃদ্ধির উপযুক্ত পরিবেশ হিসেবে কাজ করে।
মল ব্যবস্থাপনা: পোল্ট্রি মল রোগ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই নির্দিষ্ট সময় পর পর লিটার থেকে মল সরিয়ে ফেলতে হবে। অন্যথায় মলের উপরে জীবাণুনাশক যেমন ভিরকন, মেলাথিয়ন ইত্যাদি ছিটিয়ে দিতে হবে। বর্ষায় মশা, মাছি এবং অন্যান্য পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। তাই শেডের চারপাশে জীবাণুনাশক স্প্রে করে শেডকে রোগমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সংগৃহীত
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৬জুলাই ২০২২