একটি বাছুর থেকে একশ গাভীর খামার করার গল্প!

880

safe_image

গাভী পালন করে সফলতা অর্জন করেছেন আমিরুল ইসলাম। তার ‘তন্ময় ডেইরি ফার্মে’ প্রতিদিন ৩শ থেকে ৩ শ ৫০ লিটার দুধ বিক্রি হয়। পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত কিছু জমিজমা দিয়ে ভালোই চলছিল আমিরুলের। কিন্তু তার মনে স্বপ্ন ছিল, নিজে কিছু করবেন। সেই ভাবনা থেকে ১৯৯২ সালে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে শংকর জাতের একটি বকনা বাছুর কেনেন। সংসার দেখাশুনার পাশাপাশি বকনা বাছুরটিকে নিজেই লালন পালন করতে থাকেন। প্রথম থেকেই তার স্ত্রী তাকে সহযোগিতা করে আসছেন।

দু’বছরের মাথায় কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ওই গাভী বাচ্চা প্রসব করে। গাভী থেকে প্রাপ্ত দুধ বাজারে বিক্রি করে সংসার পরিচালনা করেও কিছু টাকা উৎবৃত্ত হয়। ওই গাভী এক বছর পর আবার একটি বাচ্ছা দেয়, এভাবে যতো বকনা বাছুর হয়, তা খামারে রেখে দেন এবং ষাঁড় বাছুরগুলো বিক্রি করে দেন। এভাবে একটি গাভী থেকে বর্তমানে তার খামারে ১শ গাভী। এভাবেই তার ভাগ্যের চাকা পাল্টাতে থাকে।

সরেজমিনে ওই দুগ্ধ খামারে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে তার বিদেশি জাতের ৪৫টি গাভী দুধ দেয়, ৩০টি গাভী বিভিন্ন পর্যায়ে গর্ভবতী, খামারে সদ্য প্রসব করা বাছুর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত বাছুর রয়েছে ৩০টি। আমিরুল জানান, এখন প্রতিবছর তার খামারে ২০-২৫ গাভী বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার খামারের পাশে একশটি বকনা বাছুর দিয়ে আরো একটি খামার করার চিন্তা ভাবনা করছেন তিনি।

তার কাছে খামারের লাভ-ক্ষতির কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রতিদিন তার খামারে ৩ শ-৩ শ ৫০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। লিটারপ্রতি ৪০ টাকা করে বিভিন্ন কোম্পানিতে তিনি দুধ বিক্রি করেন, যার বর্তমান বাজার মূল্য ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। তার খামারের গরুর খাবার, ৭ জন শ্রমিকের বেতনসহ আনুসঙ্গিক খরচ বাবদ প্রতিদিন ব্যয় হয় ১০-১১ হাজার টাকা। অর্থাৎ তার প্রতিদিন দুধ থেকে আয় হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা, বাৎসরিক হিসেবে দুধ থেকে আয় ১০-১২ লাখ টাকা।

তিনি তার খামার থেকে প্রতি বছর দেড় থেকে দু’বছরের বাছুর বিক্রি করেন ২০-৩০টি। প্রতিটি ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা হিসেবে তিনি বছরে পান ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। খামারের যে গাভীগুলো দুধ দেয়ার ক্ষমতা নিম্ন পর্যায়ে চলে যায় অর্থাৎ যে সময় গাভী থেকে প্রাপ্ত দুধ বিক্রি করলে লাভ থাকে না, সেগুলো স্থানীয় বাজারে মাংস হিসেবে বিক্রি করে দেন। আমিরুল ইসলাম বছরে প্রায় ১০-১৫টি গাভী বাজারে মাংসের জন্য বিক্রি করে তা থেকে পান ৫-৬ লাখ টাকা।

এ ছাড়া তার খামার থেকে যে গোবর হয় তা দিয়ে তিনি নিজের জমিতে ফসল উৎপাদনের কাজে এবং খামারের গরুর ঘাস উৎপাদনে ব্যবহার করেন। উৎবৃত্ত গোবর বিক্রি করে তিনি বছরে পান ৩-৪ লাখ টাকা। তিনি খুব শিগগিরই ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদনে যাবেন বলে আমাদের জানান এবং সেখান থেকেও আরো ১০-১২ লাখ টাকা আয় করবেন বলে ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তার খামারটি ৫ শতাংশ জায়গা থেকে সম্প্রসারিত হয়ে এখন পাঁচ বিঘারও বেশি ।

শুধু ইচ্ছাশক্তি, অক্লান্ত পরিশ্রম আর সাধনার বলে তিনি গড়ে তুলেছেন এমন একটি বিশাল গো-খামার। দুগ্ধ খামার করে এখন তিনি কোটিপতি। আদর্শ দুগ্ধ খামারি হিসেবে এখন পুরোজেলায় তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোপূর্বে তিনি জাতীয় পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। তার খামার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ওই এলাকায় আরো ২০-২৫টি দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে। তিনি সেসব খামার মালিকদের যথারীতি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

প্রাণ দুগ্ধ কোম্পানি লিমিটেড এবং বাঘাবাড়ি মিল্ক ভিটা লিমিটেড এ দু’টি প্রতিষ্ঠান কাছে হওয়ায় ওই অঞ্চলের খামারিরা সহজেই তাদের উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে পারেন। বর্তমানে তার খামারে সর্বোচ্চ প্রতিটি গাভী আড়াই লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকার ৭৫টি গাভী রয়েছে। তিনি নিজেই গাভীর প্রাথমিক চিকিৎসা করে থাকেন। বিশেষ প্রয়োজন হলে মিল্কভিটার প্রাণিসম্পদ ডাক্তার, প্রাইভেট প্রাণিসম্পদ ডাক্তার ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছে যান।

তিনি আরো জানান, কোনো উদ্যোক্তা যদি খামার তৈরির আগ্রহ প্রকাশ করেন তাহলে তিনি সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। কারো খামার তৈরি করার পর যদি সাধারণ সমস্যা হয় তাহলে মোবাইল ফোনে সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেন, তাতে সমাধান না হলে খামারে গিয়ে সমাধান করেন। এলাকায় আমিরুল একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, চেষ্টা আর একাগ্রতার মাধ্যমে ভাগ্যবদলের এক সফল নায়ক তিনি।

খামার থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় আমিরুল বেকার যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমাদের দেশে পড়াশোনা শেষ করে বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা গতানুগতিক চাকরির আশায় বসে থাকেন। এসব চাকরির আশায় না থেকে আমরা যদি নিজেরাই আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কিছু গঠনমূলক কাজ করি তাহলে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি সমাজকেও কিছু উপহার দিতে পারব। এজন্য দরকার আত্মবিশ্বাস এবং কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠা।”

সমাজে এমন অনেক ব্যতিক্রমী পেশা রয়েছে যেখানে একটু পরিশ্রম ও চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ করলে সফলতা আসবেই। আমরা যারা আত্মকর্মসংস্থানের কথা ভাবছি তারা আমিরুল ইসলামের খামার পরিদর্শন করলে জীবনকে বুঝতে পারবে খুব সহজেই।

ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ
এগ্রিফার্মস২৪/জেডএইচ