বকুল হাসান খান
কম সময়ের মধ্যে মসলা ফসল উৎপাদনে ধনিয়া উল্লেখযোগ্য। ধনিয়া রবি ফসল হলেও এখন প্রায় সারা বছরই এর চাষ করা যায়। ধনিয়ার কচিপাতা সালাদ ও তরকারিতে সুগন্ধি মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ধনিয়ার পুষ্ট বীজ বেঁটে বা গুঁড়া করে তরকারিতে মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
যা আছে ধনিয়ায় : ধনিয়া একটি পুষ্টিকর মসলা। প্রতি ১০০ গ্রাম ধনিয়া পাতায় ৩.৩ গ্রাম আমিষ, ৪.১ গ্রাম শর্করাসহ ক্যারোটিন (ভিটামিন ‘এ’) ৬ হাজার ৭২ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন ‘বি২’ বা রিবোফ্লাভিন ০.১৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-‘বি’ ১৩৫ মিলিগ্রাম, আয়রন ২০.১ মিলিগ্রাম ও ক্যালসিয়াম ২৯০ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়। এছাড়াও স্বল্প পরিমাণে ভিটামিন ‘বি১’ এবং চর্বি রয়েছে। সব মিলে যার খাদ্যশক্তি ৩৮ কিলো ক্যালরি। অন্যদিকে পুষ্ট বীজের (যা গুঁড়া মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়) প্রতি ১০০ গ্রামে আমিষ ১৪.১ গ্রাম, শর্করা ২১.৬ গ্রাম, চর্বি ১৬.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৬৩০ মিলিগ্রাম, আয়রন ১৭.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘বি১’ ০.২২, ভিটামিন ‘বি২’ ০.৩৫ মিলিগ্রাম ও ক্যারোটিন বা ভিটামিন ‘এ’ ১৪২ মাইক্রোগ্রাম থাকে। যা থেকে খাদ্যশক্তি পাওয়া যায় ২৮৮ কিলো ক্যালরি।
ধনিয়ার জাত ও পাতা উৎপাদন : সব ধরনের জমিতে ধনিয়া জন্মালেও দো-আঁশ এবং বেলে দো-আঁশ মাটিতে ফলন ভালো হয়। তবে ধনিয়ার জমিতে কোনো অবস্থায়ই পানি জমতে দেয়া যাবে না। ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখা ধনিয়া চাষের পূর্বশর্ত। ধনিয়ার পাতা উৎপাদনকারী জাতের মধ্যে বারি ধনিয়া-১ বেশ ভালো ফলন দেয়। এছাড়াও রয়েছে লালতীরের সুগন্ধা, এলবি-৬০ ও এলবি-৬৫। লালতীরের ধনিয়ার জাতগুলো সারা বছরই চাষ করা যায়। এই জাতগুলো রঙ উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের, সুগন্ধযুক্ত ও দেরিতে ফুল উৎপাদনকারী অর্থাৎ অনেকদিন ধরে পাতা উৎপাদন করে। যেখানে বন্যার পানি ওঠে সেখান থেকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধনিয়ার বীজ ছিটিয়ে বোনা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে জমি চাষের প্রয়োজন না-ও হতে পারে। তবে মাটির রস কমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আগাম চাষে দাম যেমন বেশি পাওয়া যায়, তেমনি বাজারে এর সরবরাহ বাড়িয়ে মানুষের জন্য পুষ্টিকর সালাদ এবং মসলার চাহিদাও পূরণ করা যায়। স্থানীয় দেশি জাতের ধনিয়া রবি মৌসুম ছাড়া আগাম চাষ করা যায় না। রবি মৌসুমের জন্য আশ্বিন-কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ধনিয়ার বীজ বপন করতে হয়। তবে এর পরেও ধনিয়ার বীজ বপন করা যায়, যেহেতু ধনিয়ার পাতা ৩০ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যেই সংগ্রহ করা যায়। বীজ বপনের আগে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়।
এতে বীজ শোধন ও বীজের ত্বক নরম হয়ে অঙ্কুরোদ্গমের সহায়ক হয়। জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে এবং সমান করার পর ১ মিটার প্রস্থ্যের বেড তৈরি করতে হয়। বেডে ২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারি করে সারিতে বীজ ছিটিয়ে বুনে দিতে হয়। বেডে সারি বরাবর একটি রশি টেনে রশি ধরে হাতের আঙুল বা একটি কাঠি দিয়ে ২-৩ সেন্টিমিটার গভীর করে নালা করতে হয়। নালায় বীজ ফেলে হালকা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। প্রতি শতকে ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। এই পরিমাণ বীজে প্রায় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ধনিয়া গাছ পাওয়া যায়। জমি তৈরির শেষ সময়ে প্রতি শতকে ৪০ কেজি গোবর বা জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১২৫ গ্রাম এমওপি সার এবং চারা গজানোর সপ্তাহখানেক পর থেকে দুই কিস্তিতে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১২৫ গ্রাম এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হয়। সার দুটি সেচের পানির সঙ্গেও উপরি প্রয়োগ করা যায়। সার প্রয়োগের পর জো অবস্থা বুঝে হালকা সেচ দিতে হয়। চারা বৃদ্ধির পর্যায়ে মাটির রসের অবস্থা বুঝে মাঝে মধ্যেই সেচ দিতে হয়। চারা গজানোর পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা দরকার।
আগাছা পরিষ্কারের সময় সম্পূর্ণ জমির মাটি আলগা করে দিতে হয়। যখন ৬-৭টি পাতা হয় তখন কিছু চারা তুলে পাতলা করে দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহে এভাবে পাতলা করে দিলে একদিকে যেমন খাওয়া বা বিক্রির ব্যবস্থা হয়, তেমনি গাছগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। বীজ বপনের ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর পাতা সংগ্রহ শুরু করা যায়। পরবর্তী সময়ে মাসখানেক ধরে এ সংগ্রহ চালিয়ে যাওয়া যায়। এতে ১ শতক জমিতে ১৫ থেকে ২০ কেজি পাতা পাওয়া যায়। আবার বীজ সংগ্রহের জন্য গাছ রেখে দিলে এবং বীজ যখন সম্পূর্ণভাবে পাকে কিন্তু গাছ প্রায় সবুজ থাকে তখন বীজ সংগ্রহ করলে ৮ থেকে ১০ কেজি বীজ পাওয়া যায়। প্রতি শতকে ধনিয়া চাষে খরচ প্রায় ২০০ টাকা। আগাম চাষ করলে প্রতি কেজি পাতার দাম ২৫ টাকা হিসাবে প্রায় ৫০০ টাকা পাওয়া যায়। বিঘাপ্রতি চাষে অবশ্য এ খরচ কমে আসে যা প্রায় ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকার মতো এবং ৫৫০ থেকে ৬০০ কেজি পাতায় প্রায় ১৪ হাজার টাকা আয় করা যায়। অর্থাৎ ধনিয়া চাষ করে প্রতি বিঘা থেকে প্রায় হাজার দশেক টাকা লাভ করা সম্ভব।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৩ফেব্রু২০২০