কচুর রোপণ পদ্ধতি ও পরিচর্যা সম্পর্কে জেনে নিন

1692

বাঁজারে স্বামী সবজি হিসাবে পরিচিত এই কচুর মুখী। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই সবজিটি অনেকের কাছেই খুব প্রিয়।
কম খরচ ও পরিশ্রমে অধিক পরিমাণে কচুরমুখী ফলানো সম্ভব। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ সবজিটি নিয়ে আজকের আয়োজন

আর্দ্র ও উষ্ণ আবহাওয়ায় কচুরমুখীর উৎপাদন ভালো হয়। এ সবজি চাষের জন্য দোআঁশ মাটি উত্তম। মুখি রোপণের জন্য মাঝারি উঁচু জায়গা বেছে নিতে হয়। চাষের জন্য ছায়াযুক্ত জমি নির্বাচন করা উচিত। তাই বেশিরভাগ বাড়ির আনাচে-কানাচে কচুরমুখী জন্মানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

রোপণ পদ্ধতি

মাঘের মাঝামাঝি থেকে ফাল্গ–নের মাঝামাঝি পর্যন্ত ও চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কচুরমুখী রোপণের সঠিক সময়। কচুরমুখী উৎপাদনের জন্য জমি বেশ কয়েকবার চাষ দিতে হয়। তা না হলে মুখি বড় হয় না, মানও খারাপ হয়। রোপণের আগে শেষ চাষের সময় গোবর, টিএসপি, জিপসাম, দস্তা ও বোরন সারসহ অল্প পরিমাণে ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে।

রোপণের সময় কচুরমুখীর বীজ ব্যবহার করা হয়। সাধারণত জমি চাষের পর মাটি সমান করে সারি করে রোপণ করতে হয় বীজ। লাঙ্গল দিয়ে সারি বরাবর নালা টেনে এর মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্বে বীজ ফেলে দু’পাশের মাটি টেনে নালা ঢেকে দিতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সেন্টিমিটার আর গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪৫ সেন্টিমিটার হতে হবে। বীজ বপনের গভীরতা হবে আট থেকে ১০ সেন্টিমিটার।

বীজ রোপণের প্রায় দেড় মাস পর আবারও ইউরিয়া ও পটাশ সার দিতে হবে। দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে গাছের নিচে ও ওপরে সার ছিটিয়ে দিতে হবে। গাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে গেলে সবজিটি তুলতে হয়। অর্থাৎ রোপণের ছয় থেকে সাত মাস পর এ সবজি তোলা যায়।

পরিচর্যা

# রোপণের দুই মাস পরপর আগাছা দমন করতে হবে। নিড়ানি বা ছোট কোদাল দিয়ে সাবধানে আগাছা দমন করতে হবে।

# কচুরমুখী যেহেতু উষ্ণ আবহাওয়ায় রোপণ করা হয়, তাই জমিতে রস থাকার সম্ভাবনা খুবই কম থাকবে। সুতরাং দুই সারির মাঝখানে নালা করে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অতিরিক্ত সেচ দেওয়া যাবে না। পানি যেন না জমে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তাই পরিমিত মাত্রায় সেচ দিতে হবে।

# অবশ্যই কচু গাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে উঁচু করে দিতে হবে, যাতে কচুর গোড়ায় পানি না জমে।

সংরক্ষণ

কচুরমুখী সতর্কতার সঙ্গে তুলতে হবে। তোলার পর কাটা, পচা, ক্ষতযুক্ত ও ছোট-মাঝারি আকার অনুযায়ী বাছাই করে আলাদা করে রাখতে হবে। ঠাণ্ডা, ছায়াময় ও বাতাস চলাচল করতে পারে এমন জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে। শুকিয়ে নিলে কচুরমুখীর সঙ্গে যুক্ত ময়লাগুলো পড়ে গিয়ে পরিষ্কার হবে। এরপর ঘরের ঠাণ্ডাযুক্ত জায়গায় মাচা করে রাখা যেতে পারে। অথবা মেঝেতে কাঠের ওপর রেখে বালি দিয়ে ঢেকেও সংরক্ষণ করা যায়। এভাবে ছয় মাস রাখা যেতে পারে।

পোকামাকড় ও রোগবালাই

কচুরমুখীতে রোগবালাই খুব একটা হয় না। এতে পোকামাকড়ের আক্রমণও কম হয়।

পোকামাকড়

# কচুরমুখীতে শোষক পোকা বা শ্যামপোকা, জাবপোকা ও সাদামাছি আক্রমণ করে। এতে মুখি পচে যায়। এটি দমনের জন্য কৃষি দফতরের পরামর্শ অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। ১০ দিন পরপর কীটনাশক স্প্রে করতে হবে

# কচুর পাতায় এক ধরনের লেদা পোকা আক্রমণ করে। এছাড়া লাল মাকড়ও ক্ষতি করে থাকে। মাঝেমধ্যে কাটুই পোকাও আক্রমণ করে। এতে পাতা মুড়িয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কারটাপজাতীয় কীটনাশক পানির সঙ্গে মিশিয়ে কিছুদিন পরপর স্প্রে করতে হবে।

রোগ

# কচুরমুখীতে ঝলসানো নামে এক ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এটি মূলত ছত্রাকজাতীয় রোগ। এ রোগ দমনে ছত্রাকনাশক ওষুধ ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। রোপণের ১৫ দিন পর স্প্রে করলে এ রোগ আক্রমণের ভয় থাকে না।

# পাতায় দাদ রোগ দেখা যায়। এ রোগ দমনে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।

সতর্কতা

বালাইনাশক বা কীটনাশক ব্যবহারের আগে মেয়াদ দেখে নিতে হবে। এরপর সঠিক নির্দেশাবলি মেনে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। ওষুধ ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোশাক পড়ে ব্যবহার করতে হবে। ওষুধ ছিটানো জমির পানি যাতে অন্য জমিতে না যায় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। ওষুধ দেওয়ার দুই-তিন দিন পর ফসল তোলা যাবে না। অন্তত ১৫ দিন পর ফসল তুলতে হবে।

পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ

সাধারণ সবজি হলেও কচুরমুখী পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ একটি খাবার। তবে গলা ধরা বা চুলকানোর ভয়ে অনেকেই সবজিটি খেতে চান না বা বিরক্তবোধ করেন। অথচ এ সবজি আমাদের শরীরে ওষুধের মতো কাজ করে।

শরীরের ব্যথা দূরীকরণ: কচুরমুখী শরীরের যে কোনো ব্যথা দূর করতে বেশ সহায়ক। অনেকের গিরায় গিরায় ব্যথা হয়। তারা কচুরমুখী খেলে উপকৃত হবেন। ব্যথা পুরোপুরি না কমলেও সহনীয় পর্যায়ে আসে।

দুর্বলতা হ্রাস করে: দুর্বলতারোধে কচুরমুখী খেতে পারেন। এটি এনার্জি ধরে রাখে। ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকে বলে অ্যাথলেটদের, বিশেষ করে দৌড়বিদদের জন্য একটি উত্তম খাবার।

ওজন কমায়: ওজন কমায় কচুরমুখী। ওজন কমাতে চাইলে নিয়মিত খেতে পারেন। কারণ এতে ক্যালরির পরিমাণ খুবই কম। তাই ওজন বাড়তে দেয় না।

হজমে সহায়ক: পেটের সমস্যা দূর করে কচুরমুখী। এ সবজিতে প্রচুর আঁশ থাকে বলে পরিপাক প্রক্রিয়ার জন্য খুবই উপকারী। এটি দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতেও সাহায্য করে।

আমাশয় দূর করে: আমাশয় হলে কচুরমুখীর ভর্তা খেলে উপকার পাওয়া যায়। লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে কয়েক দিন এ ভর্তা খেলে আমাশয় ভালো হয়।

পাকস্থলী পরিষ্কার করে: আঁশসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিপাক প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার পাশাপাশি পাকস্থলীর বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনেও সহায়তা করে।

হার্টের জন্য উপকারী: এ সবজি হার্টের ঝুঁকি কমাতে বেশ উপকারী। কচুরমুখীতে ফ্যাট ও কোলেস্টেরল কম থাকে বলে ধমনি শক্ত হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে। তাই নিশ্চিন্তে কচুরমুখী খেতে পারেন। শরীরে ভিটামিন ডি গ্রহণের মাত্রার ১৯ ভাগ পূরণ করে এক কাপ কচুরমুখী।

উচ্চ রক্তচাপ কমায়: হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের কম চর্বিযুক্ত ও কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এক কাপ কচুরমুখীতে ২০ গ্রাম সোডিয়াম ও শূন্য দশমিক এক গ্রাম ফ্যাট থাকে বলে খাবারটি রোগীদের জন্য ভালো। কিডনি রোগীদের জন্য এটি ভালো খাবার।

অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ: ভিটামিন ‘সি’র উৎস এটি। এক কাপ কচুরমুখী দৈনিক ভিটামিন ‘সি’র চাহিদার ১১ ভাগ পূরণ করতে সক্ষম। শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে সবজিটি। এ ভিটামিন দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়তে সাহায্য করে। কপার, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম, আয়রন, সেলেনিয়াম, পটাশিয়াম, বিটা ক্যারোটিন ও ক্রিপ্টোজেন্থিন নামক খনিজ উপাদান রয়েছে এতে। উপাদানগুলো রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।

বয়স বৃদ্ধি প্রতিহত করে: কচুরমুখীতে থাকা বিভিন্ন ভিটামিন, যেমন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ধীর গতির করে। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনও রয়েছে।
ক্যানসার প্রতিরোধ করে: কচুরমুখীতে প্রায় ১৭ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড, ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ অয়েল থাকায় এটি ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছাড়া কার্ডিওভাস্কুলার রোগ ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে বেশ সহায়ক।

কচু চাষে সফলতা

প্রাচীনকাল থেকে আজও বসতবাড়ি কিংবা পুকুরের কিনারায় কচুগাছ চোখে পড়ে। অতীতে অনেকেই সবজি হিসেবে খেত। অনেকে এড়িয়ে যেত। কালক্রমে কচুগাছের শিকড়ে গজিয়ে ওঠা কচুরমুখীও খাদ্য হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে চাষিরা এ কচুরমুখী চাষ করে আর্থিক সফলতা অর্জন করছেন। চাষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

মুনাফা তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় এ সবজি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। অনেক পরিবার স্বাবলম্বীও হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অনেকে চাষাবাদ না করে জমি ফেলে রাখতেন। এসব জমিতে কচুরমুখী চাষে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। ফলে লাভবান হচ্ছেন তারা।

কচুরমুখী চাষে ভালো মুনাফা পাওয়ায় কৃষকরা বর্তমানে শত শত একর জমি জুড়ে কচু চাষ করছেন। কেননা এতে খরচ ও পরিশ্রম তুলনামূলকভাবে কম, মুনাফা বেশি। তাছাড়া গরু-ছাগলেও কচুক্ষেত নষ্ট করে না। এর রোগবালাইও কম।
কচুরমুখীতে প্রায় সব ধরনের পুষ্টি বিদ্যমান। তাই ক্রেতাদের চাহিদা বেশি। চাহিদা থাকার কারণে বিক্রেতারা অধিক পরিমাণে কচুরমুখী বিক্রি করে সফল হচ্ছেন।

কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এক মণ কচু চাষ করলে ফলন পাওয়া যায় প্রায় ৫০ মণ। কচুক্ষেত থেকে মুখী ও শাক পাওয়া যায়। বাজারে সব কচুরই চাহিদা বেশি। উৎপাদিত মুখী ও শাক বিক্রির জন্য চাষিদের তেমন পরিশ্রম করতে হয় না। বাগান থেকে রাস্তার পাশে এনে রাখলেই ক্রেতারা কিনে নেন। কচু চাষ সম্পর্কে চাষিদের আগ্রহ থাকার কারণে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।

কচুরমুখীর বিভিন্ন পদ
# ইলিশ ও কচুরমুখীর ঝোল
# মুগডাল দিয়ে কচুরমুখীর নিরামিষ

# পটোল ও চিংড়ি দিয়ে কচুরমুখী
# কচুরমুখীর বড়া

# শুঁটকি দিয়ে চচ্চড়ি
# ইলিশের মাথা দিয়ে মুখির নুটলি

# ভর্তা
# ঘাঁটি

# মুখির দম
# কচুরমুখীর স্যুপ
# মাশরুম দিয়ে কচুরমুখী

তথ্যসূত্রঃ সেয়ার বিজ

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৪জুন২০