আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ গ্রামীণ পরিবেশে দু’চারটা করে দেশী কবুতর পালন করত। বিদেশী দামী কবুতরও গ্রামে ও শহরে দু’জায়গাতেই পালন করছে। শহরে শখের বশে দু’চারটা করে বিদেশী বিভিন্ন জাতের কবুতর পালন করলেও আজকাল অর্থনৈতিক লাভের আশায় অনেকেই বেশ বড় করে কবুতরের খামার করে আসছে। কবুতর একটি অতি সংবেদনশীল পাখি যা সহজেই বিভিন্ন ধরনের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। অতি সতর্কতার সাথে সঠিকভাবে যত্ন না করলে সাধারনতঃ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
কবুতরের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ সাধারনতঃ নিম্নলিখিত কারণে হয়ে থাকে-
ক) খাদ্যদূষণ জনিত কারণে
খ) পানিদূষণ জনিত কারণে
গ) বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের কামড়ের কারণে
ঘ) কোন স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হলে
ঙ) শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার জন্য নাক দিয়ে শ্লেষ্মা বা নিঃসৃত পদার্থের কারণে ইত্যাদি।
কবুতরের ভাইরাসজনিত রোগ নিম্নলিখিত কারণে হয়ে থাকে-
ক) দুষিত পানি পান করলে
খ) অসুস্থপাখির নাকের শ্লেষ্মা বা অন্যান্য বায়ুঘটিত (Airborne) জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে ইত্যাদি।
কবুতরের ফাংগাসজনিত (Fungus) রোগসমূহ নিম্নলিখিত কারণে হয়ে থাকেঃ
ক) ভেঁজা, স্যাতস্যাতে জায়গায় বসবাস করলে
খ) দূষিত বায়ুপ্রবাহের কারণে
গ) দূষিত পানির মাধ্যমে
কবুতরের প্রোটোজোয়া (Protozoan) জনিত রোগ সাধারনতঃ কবুতরের মা-বাবা (Parent birds) হতে আসে। তাছাড়া মা কবুতর যখন মুখের মাধ্যমে সন্তানকে খাদ্য খাওয়ায় তখন প্রোটোজোয়াজনিত রোগ মা হতে সন্তানে চলে আসে।
কবুতরের পরজীবীজনিত (Parasitic) রোগ সমূহ সাধারনতঃ
কৃমির ডিম বা লার্ভা বা পরজীবীর জীবনচক্রের কোন ধাপ (Stage) যদি কবুতর খেয়ে ফেলে তাহলে পরজীবীজনিত রোগ সমূহ হয়ে থাকে।
তাছাড়া কবুতরের কোন কোন সময় বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেল এর অভাবজনিত রোগ হতে পারে। যেমন: Plethora নামক রোগ কবুতরের হয়ে থাকে।
কবুতরের রোগসমূহ ও এর প্রতিকার এবং চিকিৎসাঃ
১. ঠান্ডাজনিত রোগ (Colds): কবুতরের মানুষের মত ঠান্ডাজনিত রোগ হয়ে থাকে। সাধারনতঃ ভেজা বাসস্থান বা ভেজা আবহাওয়াজনিত কারণে (অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম) ঠান্ডাজনিত রোগ হয়ে থাকে। এসময় কবুতরের নাক দিয়ে তরল পদার্থ নিঃসৃত হয়। এ সময় এক্সপেকটোরেন্ট (Expectorant) জাতীয় সিরাপ খাওয়ালে সহজেই ঠান্ডাজনিত রোগ ভাল হয়ে যায়।
২. ডাইরিয়া (Diarrhoea): কবুতরের ডাইরিয়াজনিত রোগ সাধারনতঃ অম্লদূর্গন্ধযুক্ত, মল্ডি (Moldy) এবং অপরিনিত শস্য-দানা খেয়ে ডাইরিয়া দেখা দেয়। ডাইরিয়া হলে ওরস্যালাইন-এন জাতীয় খাবার স্যালাইন খেতে দিতে হবে। তবে সবধরনের শস্য দানা খাওয়া প্রতিদিনের খাদ্যে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। খাদ্যের শস্যদানা এবং ধান, গম প্রভৃতি শস্যদানা কবুতরের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভাল।
৩. গোয়িং লাইট (Going light): এই রোগে কবুতরের চামড়ার রং কাল হয়ে যায় যা দেখতে গরুর মাংসের মত। এ সময় কবুতর খুব অসুস্থ দেখতে লাগে এবং প্রায়শই ডাইরিয়ায় আক্রান্ত হয়। যেহেতু এ সময় ডাইরিয়ায় আক্রান্ত হয় তাই অন্যান্য রোগ এ সময় কবুতরকে আক্রান্ত করতে পারে। তাই খাদ্যে ওরস্যালাইন এবং কুসুম কুসুম গরম দুধ ও রুটি কিছুক্ষণ পরপর দেওয়া যেতে পারে।
৪. ক্যাংকার (Canker): এটি একটি প্রোটোজোয়াজনিত রোগ যা সাধারনতঃ বয়স্ক কবুতরের দেখা যায়। মুখে বা গলায় (Throat) যদি হলুদাভ সাদা বস্তু (Substance) দেখা যায় তবে সহজেই এই রোগের সনাক্ত করা যায়। প্রোটোজোয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে এমন এন্টিপ্রোটোজোয়াল (Antiprotozoal) ঔষধ ক্যাংকার এ সেবন করা যেতে পারে।
৫. রোপ (Roup): শীতকালে যদি বিছানা ভেজা থাকে তবে প্রায়শঃই রোপ(Roup) নামের রোগটি কবুতরে দেখা যায়। এ রোগের লক্ষণ নিউমোনিয়া বা ঠান্ডাজনিত রোগের লক্ষণের মত। নাক দিয়ে শ্লেষ্মাজাতীয় পদার্থ বের হয়। এই সময় অসুস্থ কবুতরকে তার বাসস্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে বাসস্থান, খাবার পাত্র পানির পাত্র সহ সব যন্ত্রপাতি জীবাণূনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা উচিত।
৬. নিউমোনিয়াঃ যদি গলার মধ্যে বিশেষ করে থ্রট (Throat) এ কোন ধরনের গুটি দেখা যায় বা কফ জাতীয় কোন পদার্থ দেখা যায় এবং নাকের ছিদ্রে শ্লেষ্মাজাতীয় কোন পদার্থ দেখা যায় এবং যদি কবুতর এর শ্বাসকষ্ট দেখা যায় তবে বুঝতে হবে যে কবুতরটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। এ সময় গা অনেক গরম হয় এবং কবুতরটি খুবই অসুস্থ দেখা যায়। তাই এ সময় তাকে শুষ্ক বিছানাসহ গরম খাবার প্রদান করা উচিত।
৭. এগ বাইন্ডিং (Egg binding)ঃ কোন কোন সময় কবুতর এর ডিম পারতে কষ্ট হয়। সাধারনতঃ কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত রোগ হলে বা খাদ্যে সুষম পুষ্টি সঠিকভাবে না পেলে এগ্ বাইন্ডিং রোগে আত্রান্ত হয়। এ সময় পায়ুপথ গরম পানি দিয়ে ধৌত করে বা পায়ুপথে অলিভ ওয়েল লাগায়ে সহজেই ডিম বের করে আনা যেতে পারে।
৮. ম্যালেরিয়াঃ ম্যালেরিয়া সাধারনতঃ এক ধরনের প্রোটোজোয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই জীবানু রক্তের লোহিত কনিকাকে ধ্বংস করে। ফলে কবুতরটি আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। হাটতে পারে না এমনকি দৃষ্টির অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে চলাফেরা করে। এটিকে সহজেই এন্টি ম্যালেরিয়া জাতীয় ঔষধ যেমন- মেলানোসাইড দ্বারা সহজেই চিকিৎসা করা যেতে পারে। তাছাড়া এই রোগ থেকে মুক্ত রাখতে হলে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য ও পানি সরবরাহ করতে হবে। যে খাঁচায় পাখিকে রাখা হয় সে সব খাচা নিয়মিত জীবানুনাশক দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
৯. কক্সিডিওসিস (Coccidiosis): কক্সিডিওসিস রোগটি প্রায় সব সময় কবুতরে দেখা যায়। এটি একটি প্রোটোজোয়াজনিত রোগ। কম বয়সী কবুতর এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ রোগটি হলে পায়খানার সাথে রক্ত বা সাদাচুনা দেখা দেয়। এ রোগে কবুতর ঠিকমত দাড়িয়ে থাকতে পারে না, ওজন হ্রাস পায় এবং কম খাদ্য খায়। এ রোগে আক্রান্ত হলে কবুতর তাড়াতাড়ি মারা যায়। তাই আগে থেকেই প্রিভেনটিভ ডোজে কক্সিডিওসিস এর ঔষধ থাওয়ানো উচিত।
১০. পিজিয়ন পক্স (Pigeon Pox): এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা চামড়া ও মিউকাস মেমব্রেনকে আক্রান্ত করে। পিজিয়ন পক্স আক্রান্ত থেকে মুক্ত থাকতে হলে পিজিয়ন পক্স ভ্যাক্সিন দিতে হবে। যা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে।
চিকিৎসাঃ
১. কবুতরকে সব সময় শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে এবং Cod Liver Oil খেতে দিতে হবে নিয়মিত
২. খাদ্য শুষ্ক হতে হবে এবং যাতে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা না হয় সে রকম খাবার দিতে হবে
৩. নিউমোনিয়া হলে এন্টিবায়োটিক দ্বারা (যেমন- এনরোফ্লক্সাসিন) চিকিৎসা করা যেতে পারে
৪. ডাইরিয়ার ক্ষেত্রে একটি dose Castor oil Salts বা Epsom খাওয়ানো যেতে পারে যাতে সহজেই পাখির Alimentary Tracty System পরিষ্কার হয়ে যায়।
৫. সব সময় একজন ভেটেরিনারিয়ান-এর সাথে পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিজে না বুঝে চিকিৎসা করা উচিত নয়।
প্রতিরোধ বা প্রতিকারঃ
১. কবুতর এর বিছানাপত্র পরিষ্কার ও শুষ্ক থাকতে হবে
২. পরিষ্কার ও ফ্রেশ জীবাণুমুক্ত পানি ও খাদ্য সরবরাহ করতে হবে
৩. পিজিয়ন পক্স এর টিকা দিতে হবে
৪. কোথাও কেটে গেলে বা থেতলে গেলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করতে হবে কিছু কিছু রোগ হতে মুক্ত থাকতে হলে প্রতিদিন কবুতরের কার্যাবলী দেখাশোনা করা উচিত। প্রতিদিন কবুতরের খাদ্য, পানি, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য দেখা উচিত। সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া এবং ভেটেরিনারিয়ান এর সাথে প্রতি তিন মাস পরপর পরামর্শ করা উচিত। তাহলে সহজেই কবুতর রোগমুক্ত ও কঠিনতম অধ্যায় (Troublesome experience) হতে মুক্ত থাকতে পারবেন।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৬ফেব্রু২০২০