কম খরচে সহজেই কাশ্মীরি নুরানী আপেল কুল চাষ করবেন যেভাবে

2655

কাশ্মীরি আপেল কুল। দেখতে অনেকটা মাঝারি সাইজের আপেলের মতো। রং আপেলের মতো সবুজ ও হালকা হলুদের ওপর লাল। কৃষিবিদদের মতে, উর্বর বা অনুর্বর জমিতে কম খরচে সহজে কাস্মীরি আপেল কুল চাষ করা যায়।

বংশবিস্তার
বীজ এবং কলমের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা যায়। কলমের চারার বংশগত গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে। বীজ থেকে চারা পেতে বীজকে ভেজা গরম বালির ভেতর দেড়-দুই মাস রেখে দিলে তাড়াতাড়ি গজায়। না হলে ৬-৮ সপ্তাহ সময় লেগে যায়। কলমের চারা পেতে নির্বাচিত স্থানে বীজ বপণ ও চারা তৈরি করে তার উপর বাডিংয়ের মাধ্যমে কলম করে নেওয়া ভালো। বলয়, তালি অথবা টি-বাডিং যেকোনো পদ্ধতিতেই বাডিং করা যায়। তালি, চোখ কলমের চেয়ে সহজ।

বাডিং করার জন্য বীজের চারার রুটস্টক বয়স ৯ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত হতে পারে। স্থান ও জলবায়ুভেদে মধ্য-মাঘ থেকে মধ্য-ফাল্গুনে শুরু করে মধ্য-আষাঢ় থেকে মধ্য-ভাদ্র মাস পর্যন্ত বাডিং করা যায়। তবে মধ্য-বৈশাখ থেকে মধ্য-আষাঢ় উপযুক্ত সময়। এক্ষেত্রে সায়ন সংগ্রহের উদ্দেশে নির্বাচিত জাত এবং রুটস্টক উভয়েরই পুরনো ডালপালা মধ্য-ফাল্গুন থেকে মধ্য-বৈশাখ মাসে ছাঁটাই করে দিতে হয়। এরপর নতুন শাখাকে বাডিংয়ের কাজে লাগাতে হয়।

গাছ লাগানোর সময়ঃ

বর্ষার পর কাশ্মীরি আপেল কুলের চারা লাগানো উচিত। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এর চারা বোনা হয়। গাছ থেকে গাছ ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ৮ ফুট বাই ৮ ফুট রাখতে হবে। বিঘা প্রতি ২০০টির বেশি গাছ লাগানো যাবে। আকারে ছোট হওয়ায় গাছটি খুব সহজে পরিচর্যা করা যায়।

মাটি
যেকোনো ধরনের মাটিতেই কুলের সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়। কুলগাছ লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। তবে ভারি ও সামান্য ক্ষারযুক্ত বেলে দো-আঁশ মাটিতে কুলের ভালো ফলন পাওয়া যায়।

জমি তৈরি
বাগান আকারে চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি ভালো। তাছাড়া বাড়ির আনাচে-কানাচে, পুকুর পাড়ে বা আঙিনায় পড়ে থাকা অনুর্বর মাটিতেও গর্ত করে চাষ করা যায়।

রোপণ
বাগান আকারে চাষের জন্য বর্গাকার রোপণ প্রণালি অনুসরণীয়। রোপণ দূরত্ব ৬-৮ ফুট। জাত ও স্থানভেদে দূরত্ব কম-বেশি হবে। চারা রোপণের মাসখানেক আগে ১*১*১ মি আকারের গর্ত তৈরি করে নিতে হবে।

সার
চারা রোপণের ১০-১২ দিন আগে ইউরিয়া ২০০-২৫০ গ্রাম, টিএসপি ২০০-২৫০ গ্রাম, এমপি ২৪৫-২৫৫ গ্রাম, পচা গোবর ২০-২৫ কেজি হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।

পরিচর্যা
শুষ্ক মৌসুমে বিশেষত ফুল ও ফল ধরার সময়ে মাসে একবার সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। চারাগাছ (বীজের বা কলমে) হলে প্রথম বছর গাছটির কাঠামো মজবুত করার জন্য গাছের গোড়া থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার উঁচু পর্যন্ত কোনো ডালপালা রাখা যাবে না। এর উপরে শক্ত-সামর্থ কিছু শাখা-প্রশাখা গাছের অবস্থা অনুযায়ী রাখতে হবে। যেন ডালপালা সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে।

ছাঁটাই
ছাঁটাইয়ের সময় শক্ত-সামর্থ শাখাগুলোর গোড়া থেকে না কেটে কিছু অংশ রেখে অগ্রভাগ কেটে ফেলতে হবে। এছাড়া দুর্বল, রোগ ও কীট দৃষ্ট ও ঘনভাবে বিন্যস্ত ডালগুলো গোড়া থেকে কেটে পাতলা করে দিতে হবে। নতুন যে ডালপালা গজাবে সেগুলোও বাছাই করে ভালো ডালগুলো রেখে দুর্বল ডাল কেটে ফেলে দিতে হবে।

বয়স বাড়র সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি গাছের জন্য সার দিতে হবে।

গাছের বয়স
গোবর/ কেজি
ইউরিয়া/গ্রাম
টিএসপি/ গ্রাম
এমপি/গ্রাম
১-২
১০-১২
২৫০-৩০০
২০০-২৫০
২০০-২৫০
৩-৪
১৫-২০
৩৫০-৫০০
৩০০-৪৫০
৩০০-৪৫০
৫-৬
২১-২৫
৫৫০-৭৫০
৫০০-৭০০
৫০০-৭০০
৭-৮
২৬-৩৫
৮০০-১০০০
৭৫০-৮৫০
৭৫০-৮৫০
৯ +
৩৬-৪৫
১১৫০-১২৫০
৯০০-১০০০
৯০০-১০০০

প্রয়োগ
সার বছরে ২-৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ফল ধরা, ফল সংগ্রহ ও বর্ষার পর সার প্রয়োগ করা ভালো। সার দেওয়ার পর হালকা সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দেওয়া উচিত।

তরল সার প্রয়োগ
গাছে এক ধরনের জৈব তরল সার ব্যবহার করতে পারেন। তরল সার তৈরি পদ্ধতি : খৈল ১ কেজি, গোবর ২ কেজি, পানি ৫০ লিটার ও কুচামাছ ২৫০ গ্রাম একই সঙ্গে পানিতে ৭ দিন পচিয়ে তরল সার তৈরি করে কুল গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করবেন। খেয়াল রাখতে হবে তরল সার প্রয়োগের সময় জমিতে যেন রসের টান না থাকে সেজন্য সেচ দেয়ার ৩০ মিনিট পর এ সার প্রয়োগ করা উচিত এতে ফল গাছের উপকার হয়।

হরমোন ও দস্তা-বোরনের ব্যবহার
বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ ছাড়াও অন্য কারণে কুলের ফুল ও ফল ঝরে পড়তে পারে। যেমন- হরমোনের অসামঞ্জস্যতা, পুষ্টি উপাদানের অভাব বিশেষ করে দস্তা ও বোরনের অভাব। হরমোনের অভাবে প্লানোফিক্স নামক হরমোন স্প্রে করতে হবে। দস্তার অভাব হলে জিংক সালফেট ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। চিলেটেড জিংক ০.৫ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বোরনের অভাব কুল ফেটে যায়। এজন্য সলুবর বা বাম্পার সলুবর ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

কুল চাষে এর আগে পোকামাকড়ের আক্রমণ তেমন দেখা না গেলেও বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং কুল চাষ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু পোকা কুলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে কুলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ফসলটি রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এ পোকামাকড়ের মধ্যে কুল বাগানে ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা ও টিউব স্পিটল বাগ পোকা অন্যতম।

ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা
ফল ছিদ্রকারী উইভিল কুল গাছের মারাত্মক ক্ষতিকারক পোকা। কয়েক বছর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কুলের উন্নত জাতে এ পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। পোকার সদ্যজাত লার্ভা হালকা হলুদ বর্ণের এবং এদের পা থাকে না। পূর্ণ বয়স্ক পোকা গাঢ় বাদামি থেকে কালো বর্ণের হয়। পূর্ণ বয়স্ক পোকা কচি ফলে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে লার্ভা ও পিউপা থেকে পূর্ণ রূপ ধারণ করে।

ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা যেভাবে কুলের ক্ষতি করে থাকে –
সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বগুড়ার সূত্র মতে, সদ্য জাত লার্ভা কচি ফলের বীজে আক্রমণ করে এবং সম্পূর্ণ বীজ খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত ফলের নিচে কাল দাগ পড়ে এবং বীজের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, ফল ছোট গোলাকার হয় এবং ফ্যাকাশে ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আক্রান্ত ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ে বা গাছ শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত ফলে পোকার লার্ভা বা পিউপা বা পূর্ণ বয়স্ক পোকার মল দেখা যায়। ফলের ভেতরের অংশ খাওয়ার পর গোলাকার ছিদ্র করে পোকা বের হয়ে আসে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে বাগানের সব গাছের ফল আক্রান্ত হয়। তবে আপেল কুল ও বাউ কুলে আক্রমণ বেশি হয়। সাধারণত গাছে ফুল আসার পর এ পোকার আনাগোনা দেখা যায় এবং পরাগায়নের পর গাছে ফল ধরা শুরু হলে পোকার আক্রমণ শুরু হয়।

এ পোকা দমনের জন্য যা করতে হবে-
কুল বাগানের আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল ও আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
কুল গাছে অসময়ে আসা ফুল ও কুড়ি নষ্ট করে ফেলতে হবে।
গাছ ও মাটিতে পড়ে যাওয়া আক্রান্ত ফলগুলো সংগ্রহ করে লার্ভা বা পিউপা বা পূর্ণ বয়স্ক পোকাসহ ধ্বংস করতে হবে।

বেশি আক্রান্ত এলাকায় ফুল ধরার আগেই সব বাগান ও এলাকা অনুমোদিত কার্বারাইল জাতীয় কীটনাশক বা ডাইমেথোয়েট জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
যেহেতু পোকাটি ফলে ডিম পাড়ে এবং লার্ভা ফলের ভেতর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় সেজন্য আক্রমণের আগেই পোকা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য পরাগায়নের পর ফল ধরা শুরু হলে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।

টিউব স্পিটল বাগ
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বগুড়ার সূত্র মতে, এ পোকা কুল গাছের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে এবং এর আগে কখনও এ পোকার আক্রমণ দেখা যায়নি। পোকার নিম্ফগুলো সরু, লম্বা চুন যুক্ত টিউবের মধ্যে অবস্থান করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে।

নিম্ফগুলো টিউবের মধ্যে তাদের তৈরি ফ্লুয়িডে (fluid) নিজেকে লুকিয়ে রাখে এবং টিউবে এদের মাথা নিচে এবং পেট ওপরে রাখে। নিম্ফগুলোর পেটে একটি বর্ধিত প্লেট থাকে যা টিউবের খোলা প্রান্তে দরজা হিসাবে কাজ করে এবং টিউবকে বন্ধ করে দেয়।

ক্ষতির প্রকৃতি
পূর্ণ বয়স্ক পোকা এবং নিম্ফ ফুল থেকে রস চুষে খায়। আক্রান্ত ফুল সম্পূর্ণ রূপে শুকিয়ে যায় এবং ফল ধারণের অনুপযোগী হয়। অধিক আক্রান্ত গাছ সম্পূর্ণ রূপে ফল ধারণে ব্যর্থ হয়। এরা মধু রস নিঃসৃত করে যেখানে শুটি মোল্ড জন্মে। ছায়াযুক্ত স্থানে আক্রমণ বেশি হয়। সাধারণত কুল গাছে ফুল আসার সময় আক্রমণ বেশি হয় এবং টিউবের মধ্যে নিম্ফ দেখা যায়। পরবর্তীতে ফুল ধরা শেষ হলে এরা টিউব ছেড়ে চলে যায় এবং গাছে শুধু খালি টিউব পড়ে থাকে।

দমন ব্যবস্থাপনা
জমি সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে যাতে ডালপালায় পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায়। ছায়াযুক্ত জায়গায় কুল চাষ না করাই উত্তম।
হাত বা শক্ত লাঠি দিয়ে টিউবগুলো নিম্ফসহ ধ্বংস করতে হবে।

যেহেতু ফুল ধরার সময় এ পোকার আক্রমণ দেখা যায় সেজন্য গাছে ফুল আসার সময়ে কা- বা শাখায় টিউব দেখামাত্র সাইপারমেথ্রিন বা ফেনভেলারেট জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

ফলনঃ

পরিণত গাছে আগস্টে ফুল ধরতে শুরু করে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে ফুলের সময়। এসময় কোনো ধরনের পোকানাশক স্প্রে ব্যবহার করা যাবে না। ফুল ধরলে প্রতি ১০ লিটার জলের সঙ্গে ৩ মিলি ফাইটোনাল এম আই গুলে স্প্রে করতে হবে। এতে ফলের আকার বাড়বে এবং ফলন ভালো হবে।

গাছে প্রথম বছরেই গাছ প্রতি ১০-২০ কেজি ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। পরবর্তীতে গাছের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন বাড়তে থাকে।

এপ্রিলে ফলন তোলার পর পরিচর্যার জন্য বেশি উচ্চতার গাছগুলি কেটে দিতে হয়। এছাড়া ফুল আসার সঙ্গে সঙ্গে মাছি ক্ষতি করতে পারে। মাছির হাত থেকে ফল রক্ষা করতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে চাষ করতে হবে। মাছি ধরার ফাঁদ ব্যবহার করে দমন করতে হবে। কিংবা মিষ্টি গন্ধযুক্ত গুঁড় বা পাকা ফলের সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে রাখলে এর মধ্যে আকৃষ্ট হয়ে মাছি মারা যাবে।

ফল সংগ্রহ
মধ্য-পৌষ থেকে মধ্য-চৈত্র মাসের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। গাছপ্রতি ৫০-২০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৬জুলাই২০