কাঁকরুলের আধুনিক চাষপদ্ধতি

1315

Pic-05-9

পুষ্টিকর গ্রীষ্মকালীন সবজি হলেও এখন সারা বছরই কাঁকরুল চাষ হয়। এদের স্ত্রী ও পুরুষ ফুল আলাদা গাছে জন্মে। বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও সুস্বাদের জন্য কাঁকরোল উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়। কাঁচা ফল তরকারি, ভাজি ও ভর্তা হিসেবে খাওয়া যায়।

কাঁকরোলে প্রচুর ক্যালসিয়াম, ক্যারোটিন, ভিটামিন বি, আমিষ, শ্বেতসার ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। কাঁকরোল রক্তে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, যকৃৎ ভালো রাখে, কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে। কাঁকরোল চর্মরোগেরও উপকার করে।

খাদ্য উপযোগী ১০০ গ্রাম কাঁকরোলে ৭৯.৪ গ্রাম জলীয় অংশ, ০.৯ গ্রাম খনিজ পাদার্থ, ২.১ গ্রাম আমিষ, ০.৩ গ্রাম চর্বি, ১৭.৪ গ্রাম শর্করা, ৩৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৪১০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন, ০.০৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১ ও ০.০৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২ রয়েছে।

মাটি : দোআঁশ থেকে এঁটেল-দোআঁশ মাটি কাঁকরোল চাষের জন্য উপযোগী। তবে পরিমাণমতো জৈব পদার্থ যোগ করে অন্যান্য মাটিতেও কাঁকরোলের চাষ করা যায়। কাঁকরোল জলাবদ্ধতা মোটেও সহ্য করতে পারে না; তাই সুনিকাশিত ও বন্যামুক্ত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি কাঁকরোল চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত।

কাঁকরোলের জাত: কাঁকরোলের বেশ কয়েকটি জাত রয়েছে। সেসব জাতের মধ্যে আসামি, মণিপুরি, মুকুন্দপুরি ও মধুপুরি উল্লেখযোগ্য। আসামি জাতের ফলগুলো গোলাকার ও বেঁটে এবং খেতে সুস্বাদু। মণিপুরি জাতের ফল কিছুটা লম্বাটে ও অপেক্ষাকৃত চিকন। তবে তুলনামূলক ফলন বেশি হয় এ জাতে।

জমি তৈরি : চার থেকে পাঁচটি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে কাঁকরোল চাষের জন্য জমি তৈরি করতে হবে। এরপর চাষের জমিতে প্রয়োজনীয় মাপের মাদা তৈরি করতে হবে।

বপন সময়: মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত সময় হলো কাঁকরোলের বীজ বা মোথা রোপণের উপযুক্ত সময়।

মাদা তৈরি: সারি থেকে সারি এবং মাদা থেকে মাদার দূরত্ব হবে ২ মিটার। মাদার সাইজ হবে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতায় যথাক্রমে ৪৫, ৪৫ ও ৩০ সেন্টিমিটার।

সারের পরিমাণ: কাঁকরোল চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি তিন থেকে পাঁচ টন পচা গোবর, ১২৫ থেকে ১৫০ কেজি ইউরিয়া, ১০০ থেকে ১২৫ কেজি টিএসপি, ১০০ থেকে ১২৫ কেজি এমওপি, ৮০ থেকে ১০০ কেজি জিপসাম সারের প্রয়োজন হয়।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি: গোবর সার জমি তৈরির সময় মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। টিএসপি, এমওপি ও জিপসাম সার মোথা লাগানোর ১৫ দিন আগে মাদার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার সমান দু’ভাগে ভাগ করে মোথা থেকে চারা গজানোর পর যথাক্রমে ১৫ ও ৩০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। মাটি অমস্নীয় হলে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।

বীজের পরিমাণ: কাঁকরোল চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০টি কন্দমূল বা মোথা বপন করতে হবে। এক্ষেত্রে কন্দমূলের ওজন হবে ১৫০ থেকে ১৭৫ কেজি। আর বীজ বুনলে হেক্টরপ্রতি এক কেজি বীজের প্রয়োজন হবে।

বীজ বা মোথা বপন: কাঁকরোল চাষের জন্য ২ মিটার দূরত্বের সারিতে ও ব্যবধানে পাঁচ থেকে ছয় সেন্টিমিটার গভীরতায় প্রতি মাদায় দুইটি করে মোথা রোপণ করে সেচ দিয়ে এবং খড়কুটোয় ঢেকে দিতে হবে। ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি ২০টি স্ত্রী গাছের জন্য অন্তত একটি পুরুষ গাছ রাখতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা: মোথা থেকে চারা গজানোর পর আগাছা জন্মালে তা দমন করতে হবে। প্রয়োজনে নালার সাহায্যে পানি সেচ দিতে হবে। অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিদিন ভোরে স্ত্রী ফুলের কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হবে। কাঁকরোলের গাছ ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হলে এর গোড়ায় একটি করে কাঠি পুঁতে দিতে হবে এবং গাছ ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা হলে মাচা তৈরি করে দিতে হবে।

পোকা দমন: কাঁকরোলের বিভিন্ন অনিষ্টকারী পোকার মধ্যে জাবপোকা, মাছিপোকা ও বিছাপোকা উল্লেখযোগ্য।

জাবপোকা: এ পোকা গাছের পাতা ও কচি কা-ের রস শুষে নেয়।দমন : আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানির সঙ্গে এক মিলিলিটার অ্যাডমায়ার বা রগর দুই মিলিলিটার মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।

মাছিপোকা: এরা ফল খেয়ে নষ্ট করে। এ পোকা কচি ফলের খোসার ভেতর ডিম পাড়ে এবং আক্রান্ত ফল নষ্ট করে।

দমন: আক্রান্ত ফল দেখামাত্র তা তুলে নষ্ট করতে হবে। ফেরোমোন ফাঁদ ও বিষটোপ ব্যবহার করতে হবে। একটি মাটির পাত্রে ১০০ গ্রাম থেঁতলানো মিষ্টিকুমড়ার সঙ্গে ০.২৫ গ্রাম সেভিন ৮৫ ডবি্লউপি মিশিয়ে বিষটোপ তৈরি করতে হবে। বিষটোপ তিন থেকে চার দিন পরপর পরিবর্তন করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে রিপকর্ড বা সিমবুশ ২০ ইসি প্রতি লিটার পানির সঙ্গে এক মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর দুই থেকে তিনবার স্প্রে করতে হবে।

বিছাপোকা: এ পোকা পাতার কচি সবুজ অংশ খায়। সিমবুশ এক মিলিলিটার অথবা ডায়াজিনন ৬০ ইসি দুই মিলিলিটার প্রতি লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

রোগ দমন: কাঁকরোলে যেসব রোগ দেখা যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চারার ঢলে পড়া, পাউডারি মিলডিউ ও মোজাইক। প্রথম দুটি ছত্রাকজনিত এবং শেষেরটি ভাইরাসজনিত রোগ।

চারার ঢলে পড়া রোগ: এ রোগের আক্রমণে কচি গাছের গোড়া পচে যায় এবং চারা ঢলে পড়ে ও মারা যায়।

প্রতিকার: পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগমুক্ত কন্দমূল বা মোথা লাগাতে হবে। আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

পাউডারি মিলডিউ রোগ: পাতার ওপর সাদা সাদা ধূসর পাউডার দেখা যায় ও পাতা মারা যায়।

প্রতিকার: রোগমুক্ত মোথা বা কন্দমূল রোপণ করতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ২ গ্রাম থিয়োভিট মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।

মোজাইক ভাইরাস: গাছের পাতা সবুজ ও হলুদ মোজাইক রোগ ধারণ করে। গাছের বাড়বাড়তি কমে যায়।

প্রতিকার: আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট করে ফেলতে হবে। নীরোগ গাছের মোথা বা কন্দমূল রোপণ করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ: কাঁকরোল হলদে সবুজ হলেই সংগ্রহ করতে হবে। গাছ রোপণের ৪৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে কাঁকরোল ফুল দিতে শুরু করে। পরাগায়নের ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাঁকরোল সংগ্রহের উপযোগী হয়।

বাজারজাতকরণ: কাঁকরোল সংগ্রহের পর বস্তাবন্দি না করে বায়ু চলাচলের সুবিধাযুক্ত বাঁশের খাঁচা বা হার্ডবোর্ডের বাঙ্করে বাজারে পাঠাতে হয়, যাতে গায়ে কোনো আঘাত না লাগে।

ফলন : ভালোভাবে যত্ন নিলে জাতভেদে হেক্টরপ্রতি কাঁকরোলের ২০ থেকে ২৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

লেখক: ডিজিএম (সম্প্রসারণ), সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড, সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন