কাঁকড়া চাষ করে অধিক লাভবান হওয়ার উপায়

142

 

অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় কাঁকড়া চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আজ এর নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে

বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে কাঁকড়া চাষ করা হয়। আমাদের দেশে কাঁকড়া চাষ মানেই খাদ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণ। এ কারণে প্রথমে ১০ থেকে ২৫০ গ্রামের ওজনের কাঁকড়া বাছাই করা হয়। পরে এগুলোকে বাক্স কিংবা খাঁচায় রাখা হয়। অনেকে পুকুরে ছেড়ে দেন। বাক্স, খাঁচা কিংবা পুকুর যা-ই হোক না কেন, তারপর খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম আকারে পরিণত করা হয় কাঁকড়াগুলো। মূলত এরপর বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী শক্ত ও নরম খোসার কাঁকড়া উভয় প্রকারই সংগ্রহ করা হয়।

পুকুরে চাষের ক্ষেত্রে
শতকরা ৫০ ভাগ কাদামিশ্রিত বেলে মাটির পুকুর কাঁকড়া চাষের উপযুক্ত। পুকুরের আকার ২০ থেকে ৪০ শতাংশ হলে কাঁকড়ার ব্যবস্থাপনা সুবিধাজনক হয়। পুকুরের পানি চার থেকে পাঁচ ফুট গভীর হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুকুরের চারপাশ বাঁশের বেড়া ও নাইলনের নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। এমন ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে কাঁকড়া বেরিয়ে যেতে পারবে না।

কাঁকড়া সাধারণত শামুক, ঝিনুক, চিংড়িসহ ছোট জাতীয় কাঁকড়া ও মাছ খেতে পছন্দ করে। তাই প্রতিদিন সকাল ও বিকালে শামুক, তাজা ছোট মাছ কিংবা বড় মাছের টুকরো ছিটিয়ে দিতে হবে। কাঁকড়ার খোলস বদলানোর সময় স্বজাতিভোজ রোধের জন্য পুকুরের কিনারে দেড় ফুট লম্বা ও ছয় ইঞ্চি ব্যাসের পর্যাপ্ত পরিমাণে টুকরো পিভিসি পাইপ দিতে হবে।

বাঁশের খাঁচায় চাষের ক্ষেত্রে
খাঁচায় কাঁকড়া চাষও বেশ লাভজনক। সাধারণত ৯টি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত বাঁশের খাঁচা কাঁকড়া চাষের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খাঁচার পাশের শূন্য দশমিক পাঁচ সেন্টিমিটার এবং ওপরের ঢাকনার মধ্যে দুই দশমিক পাঁচ সেন্টিমিটার ফাঁকা রাখতে হবে। তবে কাঁকড়ার চলাচলের সুবিধার্থে খাঁচার নিচের মধ্যে ফাঁকা রাখা যাবে না। পানি চলাচলে যেন সুবিধা হয়, সে দিকটি খেয়াল রাখতে হবে। পানি চলাচলের সুবিধার্থে খাঁচাগুলো মাঝেমধ্যে পরিষ্কার করতে হবে। প্রতিটি প্রকোষ্ঠে একটি অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটারে ৯টি কাঁকড়া মজুত করা যাবে। প্রতিদিন খাঁচার ঢাকনা খুলে কাঁকড়ার দেহের ওজনের ১০ শতাংশ হারে খাবার দিতে হবে। প্লাস্টিকের ড্রামের সাহায্যে খাঁচাগুলো পানিতে ভাসিয়ে রাখা যায়। অথবা নির্দিষ্টভাবে খাঁচার আংশিক ডুবিয়ে বেঁধেও রাখা যায়।

কাঁকড়ার উপযোগী উপকূলীয় অঞ্চল
বর্তমানে আয়ের উৎস হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করছে কাঁকড়া। মাছের পাশাপাশি কাঁকড়া চাষও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে মাছের মতো এরা যে কোনো জায়গায় সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। এরা সাধারণত উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাই উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়ার চাষ ভালো হয়। এ অঞ্চল চাষের উপযোগী হওয়ায় খাতটি স্বল্প পুঁজিতে অল্প সময়ে লাভজনক। ফলে এখানে কাঁড়ার চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
উপকূলীয় অঞ্চলবর্তী খুলনা, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ভোলা, নোয়াখালী, হাতিয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরগুনায় কাঁকড়া চাষ করে জীবিকা উপার্জন করছেন চাষিরা। এক সময় এসব জায়গায় প্রচুর পরিমাণে কাঁকড়া পাওয়া যেত। চাষ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না বলে এর কদর ছিল কম। বর্তমানে এ অঞ্চলে হাজার হাজার লোক কাঁকড়া চাষের দিকে ঝুঁকেছে। জানা গেছে, এখানে ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ করায় বেশ সহজ ও লাভজনক হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঁকড়া চাষ ও ফ্যাটেনিং এক জিনিস নয়। বাংলাদেশে সাধারণত কাঁকড়া চাষের তেমন প্রচলন নেই বলেই ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে চাষ করা হয়ে থাকে। মূলত কাঁকড়া চাষ হচ্ছে পোনা বা ছোট কাঁকড়াকে চাষকৃত পুকুরে ছেড়ে দিয়ে একে বড় করে বাজারজাত করা। আর ফ্যাটেনিং হচ্ছে বাজারে বিক্রির উপযুক্ত অপরিপক্ব পুরুষ কাঁকড়া ও স্ত্রী কাঁকড়াকে চাষকৃত পুকুরে বাঁশ বা নেটের পাটা দিয়ে চারপাশ ঘিরে এর মধ্যে কাঁকড়া ছেড়ে দিয়ে ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে বাজারজাত করা।

প্রাণিবিদ-গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১৫ জাতের কাঁকড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রায় ১১টি সামুদ্রিক। আর চারটি মিষ্টিপানি ও উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়।

আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেশি
কাঁকড়া ব্যবসার সঙ্গে অর্থনীতির নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। অল্প পুঁজি ও অল্প জায়গায় কাঁকড়া চাষ শুরু করা যায়। ফলে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উৎপাদন করা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর পরিমাণে রফতানিও হচ্ছে। সংগত কারণে সরকার এ খাতকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় কাঁকড়ানির্ভর শিল্পও গড়ে তোলা হচ্ছে।

বিদেশে কাঁকড়ার চাহিদা তুলনামূলক বেশি। তাই রফতানির তালিকায় এ পণ্যের চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বদলে দিচ্ছে হাজারো মানুষের ভাগ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি লাভ হওয়ায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে ক্রমেই বাড়ছে রফতানি আয়।

আমাদের দেশ থেকে শক্ত খোসার কাঁকড়া তুলনামূলক বেশি রফতানি করা হয়। নরম খোসার কাঁকড়া রফতানির জন্য হিমায়িত করে পাঠাতে হয়। দেশে নরম খোসার কাঁকড়ার চাষ এখনও প্রসার লাভ করেনি।

বাংলাদেশের কাঁকড়ার বেশিরভাগ জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে রফতানি করা হচ্ছে। এ দেশগুলোয় কাঁকড়ার চাহিদা বেশি। এ খাত থেকে উপার্জিত বৈদেশিক অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সুস্বাস্থ্যের জন্য খেতে পারেন
কাঁকড়ার মাংসে অপরিহার্য ফ্যাট, পুষ্টি ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব উপাদান শরীরের জন্য বেশ উপকারী। আমাদের দেশের অনেকেই এ বিষয়ে অবগত নয়। তাই খাদ্য হিসেবে এটি সব শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। আমাদের দেশের খাবারের মেনুতে না থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পছন্দের খাবারের তালিকায় আছে এটি। সুস্বাস্থ্যের জন্য আপনিও খেতে পারেন কাঁকড়া।

রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়: কাঁকড়ায় আছে কপার, যা শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কপার শরীরে আয়রন উৎপাদন করে। আয়রন লাল রক্তের কোষ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ কারণে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং অক্সিজেনযুক্ত রক্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছানো নিশ্চিত হয়।

রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে: সব সামুদ্রিক মাছে সেলেনিয়াম থাকে। এদের মতো কাঁকড়ায়ও সেলেনিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে। এ উপাদানটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও থাইরয়েড হরমোন ঠিক রাখে।

ত্বক, চোখ ও স্নায়ু সুরক্ষা করে: কাঁকড়ার মাংসে প্রচুর পরিমাণে রিবোফ্লাভিন থাকে। রিবোফ্লাভিন ত্বক, চোখ ও স্নায়ুর সুরক্ষা করে। এছাড়া আমাদের শরীরে স্টেরয়েড উৎপাদন ও লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে বিশেষ সাহায্য করে রিবোফ্লাভিন।

হার্ট সুস্থ রাখে: কাঁকড়াতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে। গরুর মাংসে যে পরিমাণে প্রোটিন থাকে, কাঁকড়াতেও সেই পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে। কিন্তু গরুর মাংসে চর্বি থাকে বলে তা হার্টের জন্য ক্ষতিকর। কাঁকড়াতে চর্বি নেই বলে নিশ্চিন্তে এটি খেতে পারেন। এতে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না, বরং এটি হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

শরীরকে বিষমুক্ত রাখে: মানবদেহের কিডনি ও লিভারের ফাংশনকে উন্নত করে কাঁকড়া। এতে কিডনি যেমন বিপদমুক্ত থাকে, তেমনি শরীরকে বিষমুক্ত করে।

হাড়ের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে: ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস দাঁত ও হাড়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কাঁকড়ার মাংসে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে। তবে ফসফরাসের পরিমাণ বেশি। অর্থাৎ সক্রিয় জীবনধারণের নিশ্চয়তা চাইলে কাঁকড়ার মাংস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বেকার যুবকদের জন্য লাভজনক

কৃষিপ্রধান এ দেশের বেশিরভাগ যুবক চাকরির পেছনে ছোটেন। অনেকে চাকরির আশায় দীর্ঘদিন বেকার বসে থাকেন। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে সবারই মঙ্গল। চাকরির পেছনে না ছুটে উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তিতে কৃষিকাজ শুরু করলে নিজের ভাগ্য যেমন গড়ে উঠবে, তেমনি কৃষিতে উন্নয়নের মুখ দেখবে বাংলাদেশ।

অনেকে বিভিন্নভাবে খামার গড়ে তুলে কিংবা কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে। যেমন ব্রয়লার হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল, মহিষ, মাছের খামার, মধু প্রভৃতি। এমনিভাবে বেকার যুবক ও চাষিরা কাঁকড়ার চাষ করতে পারেন।

সাতক্ষীরা, কক্সবাজার ও বাগেরহাটে প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি চাষ হয়। পাশাপাশি লাভজনক হওয়ায় কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন এসব জেলার চাষিরা। এসব জেলায় বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। কাঁকড়া সহজে রোগাক্রান্ত হয় না, তাই চাষিরা চিন্তাহীনভাবে চাষ করতে পারেন। তাই আমাদের দেশে কাঁকড়া চাষের আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। সরকারিভাবে বেকার যুবকদের কাঁকড়া চাষের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। শুধু প্রশিক্ষণ নয়, মূলধন দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছে সরকার। যুবকদের পাশাপাশি নারীদের মাঝেও কাঁকড়া চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।