‘কাক্সিক্ষত’ ইলিশ না মিললেও উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন জেলেরা

147

আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এই তিন মাসে বঙ্গোপসাগরে বসে ইলিশের মেলা। এ সময় ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে রুপালি ইলিশ। তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বর পার হয়ে অক্টোবর মাস পাড়ি দিলেও সাগরে এখনও মিলছে না কাক্সিক্ষত সেই ইলিশের দেখা। এর ফলে মাছ ধরা না পড়ায় অভাব-অনটনে আর হতাশার মধ্যে দিন পার করছে বাঁশখালী উপকূলের ৩০ হাজার জেলে পরিবার।

এদিকে কাক্সিক্ষত ইলিশের দেখা না মিললেও পেটের দায়ে সেই কাক্সিক্ষত ইলিশের খোঁজে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন জেলেরা। তবে কি ইলিশ, না ইলিশের সঙ্গে সঙ্গে সেই টুনা, পোপা, লইট্টা, রূপচাঁদা, ছুরি, রিটা, সুরমাসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছও যেন জেলেদের ভুলে গেছে। সামুদ্রিক মাছ এখন সাগরে নেই বললে চলে। সাগরে নি¤œচাপ দেখা দেওয়ার পরও কাক্সিক্ষত ইলিশের খোঁজে উত্তাল সমুদ্রে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন জেলেরা। তবুও ইলিশ নামে সোনার হরিণের খোঁজে নিজের জীবন বাজি রেখে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন জেলেরা।

সরেজমিনে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় মৎস্যঘাট বাঁশখালীর ফাঁডির মুখ ও সরকার বাজার ঘুরে দেখা যায়, চারদিকে শুনশান নীরবতা, নেই কোনো হইচই। জেলে, মৎস্য শ্রমিক ও আড়ত মালিকদের নেই কোনো দৌড়ঝাঁপ। বেশিরভাগ বরফকল ও দোকানপাট বন্ধ। তারপরও কিছু মাছ ধরার ট্রলার সাগরে যায়। এর মধ্যে দু-একটি পর্যাপ্ত মাছ পায়। বাকিরা ইলিশ ধরে খুশি হতে পারছে না। ফলে ঘাট সরগরম নয়। অলস সময় পার করছেন এখানকার পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। এতে মৌসুমের এই সময়ে যে পরিমাণ মাছ আসার কথা, তার তিন ভাগের এক ভাগও আসে না। যেখানে প্রতিদিন কয়েকশ’ কোটি টাকার ইলিশ ক্রয়-বিক্রয় হয়, সেখানে ১০ কোটি টাকাও ওঠে না। অতঃপর ইলিশও নেই, কোনো কেনাবেচাও নেই।

ছনুয়ার জেলে আবদুল করিম বলেন, ‘সাগরে চাহিদামতো ইলিশ ধরা পড়ছে না। অনেক সময় মাছ বিক্রিতে বাজার খরচ ও তেলের টাকাও হয় না। আমরা সাগরে যাওয়ার আগে ট্রলার মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুদের ওপর দাদন নিয়ে থাকি। দীর্ঘদিন ধরে সাগরে ইলিশ ধরা না পড়ায় এখন ওই টাকাও ফেরত দিতে পারছি না। এরকম চললে আমরা জেলেরা না খেয়ে মরব।’

সরলের আবদুল্লাহ মাঝি জানান, ‘চলতি মৌসুমের শুরুতে কয়েক দিন ছোট সাইজের ইলিশ ধরা পড়েছিল। এরপর আর ইলিশের কোনো দেখা নেই। এমনকি অন্যান্য কোনো মাছও ধরা পড়ছে না। এখন মৌসুম শেষের পথে, পর্যাপ্ত ইলিশ ধরা পড়ার কথা থাকলেও কোনো ইলিশ ধরা পড়ছে না। এ ছাড়া কয়েক দিন পরপর সাগরে আবহাওয়া খারাপ থাকায় গভীর সমুদ্রে যেতে পারছি না। এখন মনে হচ্ছে মাছ ধরার পেশাটাও ছেড়ে দিতে হবে।’

বোট মালিক সমিতির নেতারা বলেন, ‘বন্ধের সময় ইন্ডিয়ান ও মিয়ানমারের জেলেরা বাংলাদেশে এসে মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের মোহনা ও নদীতে নিষিদ্ধ বেহুন্দী, গড়া, বাঁধা, ঘোপ জাল দিয়ে অবাধে ছোট মাছ শিকার চলছে। এখন নতুন বড় বড় জাহাজ মাছ শিকার করছে। এরা কম্পিউটারে দেখে মাছ শিকার করে, তাই তারা সব মাছ ধরে নিয়ে যায়। এসব নিষিদ্ধ জাল ও বড় জাহাজ বন্ধ করা না গেলে ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

বাঁশখালী বোট মালিক সমিতির নেতা ও মৎস্য ব্যবসায়ী আব্দুর শুক্কুর বলেন, ‘সাধারণত জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস সাগর জেলেদের জন্য বহুল কাক্সিক্ষত। মূলত বর্ষার এ তিন মাসের দিকে তাকিয়ে উপকূলের জেলে ও ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করেন। প্রতিবছর এ সময় সমুদ্রে প্রচুর ইলিশের দেখা মেলে। আর এ ইলিশ বিক্রির অর্থ দিয়েই জেলেদের সারা বছরের সংসার চলত। কিন্তু এবার পুরো সাগরে কোনো ইলিশের দেখা মিলছে না। ব্যবসায়ী বলেন, জেলে বলেনÑসবাই অর্থকষ্টে দিন পার করছেন। তারপরও মাছের আশায় নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল-বিকাল সাগরে যায় ট্রলারগুলো। এরপরও অনেকটা খালি হাতে ফিরছেন তারা। জেলেদের ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, বোট নিয়ে সাগরে যাওয়া-আসার খরচও উঠছে না।’

বাঁশখালী উপজেলা সিনিয়ার মৎস্য অফিসার মো. মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বন্ধের সময় জেলেরা সাগরে চুরি করে ইলিশ ধরে, যার কারণে ইলিশ প্রজনন করতে পারে না। ছোট মাছগুলোও বড় হতে পারে না। তারা যদি সচেতন হতো, তাহলে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ থাকত। এছাড়া ইলিশ ধরা না পড়ার পেছনে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑবৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, নাব্য হ্রাস, বালি উত্তোলন, দূষণ ও মোহনাগুলো অবৈধ জাল দিয়ে ঘিরে রাখা।’