কাজুবাদামে বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা রপ্তানির স্বপ্ন

757

কাজুবাদামে বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। শুল্কবৈষম্য দূর ও শুল্ক ফাঁকি রোধ এবং নীতি সহায়তা পেলে আগামী চার বছরেই এই স্বপ্ন পূরণের ছক এঁকে ফেলেছেন তাঁরা। রপ্তানিতে এই বিশাল সম্ভাবনা দেখে মুগ্ধ হয়ে সরকারের কৃষি, অর্থ ও পরিকল্পনা এই তিন মন্ত্রণালয় একে বাস্তব রূপ দিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। সরকারের ওই যৌথ উদ্যোগে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তারাও।

সরকারের ওই তিন মন্ত্রীর কাছে এমন সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন কাজুবাদামে প্রথম ও সফল উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ তানভীর। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০২৪ সালের মধ্যে বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমাদের বছরে চার লাখ ৪৪ হাজার টন কাজুবাদাম প্রয়োজন হবে। এই মুহূর্তে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে বছরে দেড় হাজার টন। রাতারাতি তো আর দেশের উৎপাদন বাড়ানো যাবে না। উৎপাদন না বাড়া পর্যন্ত বাকি কাজুবাদাম কাঁচা আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হবে। এরপর দেশের কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে সেটি আমরা রপ্তানি করব।’

তিনি বলছেন, ‘কাঁচা কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্কবৈষম্য দূর করা, বাণিজ্যিক আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি রোধ এবং রপ্তানিতে নীতি সহায়তা দিতে সরকারের তিন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। সেটি নিশ্চিত হলে ২০২৪ সালের মধ্যেই এক বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারব। আমরা দেশি উদ্যোক্তারাও সেভাবে প্রস্তুত হচ্ছি। শুধু তাই নয়, আমাদের স্বপ্ন ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম কাজুবাদাম রপ্তানিকারক দেশ হওয়া।’

কাজুবাদামে দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাছে বড় উদাহরণ হচ্ছে ভিয়েতনাম। সারা বিশ্বে কাজুবাদামের বাজার ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; এর মধ্যে ভিয়েতনাম একাই চার বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। কিন্তু সেই দেশে কাজুবাদাম উৎপাদন হয় পাঁচ লাখ টন; আরো ১৫ লাখ টন তারা আমদানি করে আনে। কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির পর দেশে প্রক্রিয়াজাত এবং রপ্তানি করে ভিয়েতনাম বিশ্ববাজারে এখন শীর্ষে।

ভিয়েতনাম মডেলের উদাহরণ টেনে শাকিল আহমেদ বলেন, ‘কাঁচা কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্কহার শূন্য করে দিয়ে দেশে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানির মাধ্যমেই ভিয়েতনামের শুরু। ধীরে ধীরে তারা দেশে আবাদ বাড়িয়েছে এবং বাকিটা আমদানি করেই চাহিদা মেটাচ্ছে। আমরাও সেই পথে আগাতে চাই।’

উৎপাদন ও আমদানির তথ্য : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, দেশে কাজুবাদাম ভোক্তার সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু আমদানির চিত্র বলছে, প্রতিবছরই বিপুল আমদানি হচ্ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মাত্র ১৮ হাজার টন কাজুবাদাম আমদানি হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সেটি বেড়ে এক লাফে এক লাখ ৩৩ হাজার টনে উন্নীত হয়। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা আরো বেড়ে তিন লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি আরো বেড়ে চার লাখ ৪৫ হাজার টনে এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি বেড়ে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টনে উন্নীত হয়। আমদানি বাড়ার চিত্রই বলছে, ব্যবসাটা ভালো যাচ্ছে।

শাকিল তানভীর বলেন, ‘প্রথম দিকে আমরা আমদানীকৃত কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত ছাড়াই রপ্তানি করেছি। তখন রপ্তানি আয়ে ভালো সাড়া মেলেনি। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ২০১৫ সালেই প্রক্রিয়াজাত করেই কাজুবাদাম রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিই। এরপর প্রক্রিয়াজাত করেই কাজুবাদাম রপ্তানি করতে থাকায় আমদানির পরিমাণ বেড়েছে।’

আমদানিতে শূন্য শুল্কে রাজস্ব আয় কমবে না : কাঁচা কাজুবাদাম আমদানিতে বর্তমানে কাস্টমস শুল্ক ৫৮ থেকে ৮৯ শতাংশ। ভারতে আমদানি এই শুল্ক আড়াই শতাংশ এবং ভিয়েতনামে শূন্য শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি হয় মাত্র ১৭ মেট্রিক টন। আর প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি হয়েছে ৫৫৯ টন। একই শুল্ক হওয়ার কারণে বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের অনেকেই প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি করে আবার রপ্তানি করছে; এতে সরকার বিপুল রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু কাঁচা কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক শূন্য করলে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি হবে না, আয়ও কমবে না। উল্টো দেশে বিপুল প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠবে এবং বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্য পূরণ সহজ হবে।

কাজুবাদাম রপ্তানির শুরু যেভাবে : কাজুবাদাম রপ্তানির শুরুটা ভালো ছিল না শাকিল আহমেদের। ২০১০ সালে বান্দরবানে বেড়াতে গিয়ে পড়ে থাকা বাদাম বাগান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে দুই ট্রাক চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। সিঙ্গাপুরে পরিচিত একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সহায়তায় রপ্তানিও করেন ভারতে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতার উত্তর শুনে তিনি বিব্রত হন কিন্তু হতাশ হননি, দমে যাননি এর প্রমাণ এর ছয় বছর পর ২০১৬ সালে নিজ উদ্যোগে কারখানা প্রতিষ্ঠা।

সহউদ্যোক্তা ইকরাম রশিদের পরামর্শে ভারতের কেরালা থেকে কাজুবাদাম বিশেষজ্ঞ নন্দকুমারকে আনা হয়। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী দানা পৃথক করে বড় দানা ভিয়েতনামে ও ছোট দানা ভারতে রপ্তানির জন্য ঠিক হলো। কিন্তু এই বাদামও দুই দেশের কোনো ক্রেতাই নিতে চাননি। শেষ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানটি ঝুঁকি নেয়। বাদাম পাওয়ার পর ভিয়েতনাম থেকে প্রথম সুখবর এলো। এর পরই পাহাড় থেকে কাজুবাদাম কিনে রপ্তানি করতে থাকেন তিনি। ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া কাঁচা কাজুবাদামের ৭৫ শতাংশ বা ১২ লাখ ২৩ হাজার ডলার রপ্তানি আয় আসে তাঁর হাত ধরে।

দেশের প্রথম কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত কারখানা : চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ডেইলপাড়ায় ২০১৫ সালে দেশের প্রথম কাজুবাদামের কারখানা ‘গ্রিনগ্রেইন ক্যাশিউ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি’ গড়ে তুলেছেন শাকিল তানভীর। বর্তমানে কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২০০ টন; আগামী নভেম্বরে উৎপাদন তিন গুণ বাড়বে। প্রতিদিন এই কারখানা থেকে দেশের অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁয় যাচ্ছে প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম। শাকিলের হাত ধরে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু উদ্যোক্তা প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তুলেছেন।

শাকিল আহমেদ তানভীর বলেন, ‘কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করার বড় কারখানা হতে পারে, তা কারো ধারণায় ছিল না। পাগলামি বলে উড়িয়ে দিয়েছিল অনেকে। কারখানা করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছি, কিন্তু দমে যাইনি। সরকার কাঁচা বাদাম আমদানিতে শূন্য শুল্ক এবং রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিলে দেশে প্রচুর প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠবে।’

দুই লাখ হেক্টর জমিতে আবাদের পরিকল্পনা : কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ লাখ হেক্টর কাজুবাদাম চাষ উপযোগী জমি রয়েছে, এর বেশির ভাগ পার্বত্য এলাকায়। দুই হাজার হেক্টর জমিতে কাজুবাদামের চাষাবাদ শুরু করা গেলে দেশে কাজুবাদামের উৎপাদন পাঁচ লাখ টনে দাঁড়াবে।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সরকার এখন কৃষিব্যবস্থাকে বহুমুখীকরণ, অপ্রচলিত ফসলের দিকে গুরুত্ব এবং উচ্চমূল্যের ফসল আবাদের প্রতি জোর দিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। আমরা বিদেশ থেকে ছয় হাজার উন্নত কাজুবাদামের চারা এনেছি, সঙ্গে বীজও এসেছে। এগুলো চাষাবাদে সাতজন কৃষককে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে।’

কাজুবাদামে বাড়ছে নতুন উদ্যোক্তা : শাকিল আহমেদের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজুবাদামের কারখানা করেছেন অন্তত ছয়জন; আসছে নতুন উদ্যোক্তা। ব্রিজ ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান নির্বাহী মীর শহীদুল হক খান কচি বলেন, ‘অনেক বছর আগে আমি আফ্রিকায় গিয়ে কাজুবাদাম উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখে আসি কিন্তু দেশে কাজ করার সাহস পাইনি। শাকিলের কাজ এবং এই শিল্পের সম্ভাবনা দেখে আমিও এই খাতে মনোযোগ দিচ্ছি। নীতি সহায়তা বাস্তবায়নে আমি পৃষ্ঠপোষকতা করছি। কভিড-১৯ অর্থনৈতিক ধকল কাটিয়ে উঠতে কাজুবাদাম দেশের জন্য ভালো বিকল্প রপ্তানি পণ্য হতে পারে।’

১০ বিলিয়ন ডলারের কাজুবাদামের বাজার : বর্তমানে সারা বিশ্বে মোট ৩৫ লাখ টন কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া, ঘানা ও বেনিনে। এসব দেশে প্রায় ১২ লাখ টন উৎপাদন হয়। কিন্তু এসব দেশ কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করতে পারে না। তারা মাত্র ১০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করে। এসব দেশের কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করে বছরে চার বিলিয়ন ডলার আয় করে ভিয়েতনাম।

সারা বিশ্বে কাজুবাদামের বাজার ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ভিয়েতনাম একাই চার বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। বাকিগুলো ভারত ও পশ্চিম আফ্রিকার কিছু দেশ থেকে রপ্তানি হয়। কাজুবাদামের বড় গ্রাহক যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো। এ ছাড়া ভারতের কেরালায়ও এই বাদামের ব্যাপক চাষ হয়।

সূত্র: কালের কন্ঠ।

ফার্মসএন্ডফার্মার/০৫সেপ্টেম্বর২০