কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উন্নত বীজ, রাসায়নিক সারের ব্যবহারে যেমন বহু বছর ধরে বাংলাদেশের কৃষকরা অভ্যস্ত, তেমনি ফসল নিরাপদ রাখার জন্য রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারও বহুল প্রচলিত। কিন্তু সব রাসায়নিক বস্তুরই ক্ষতিকর দিক আছে, যা আমাদের জমি ও প্রকৃতির যথেষ্ট ক্ষতি করে ফেলেছে এরই মধ্যে। সুতরাং রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প উপায় যদি উদ্ভাবন করা যায় তাকে বড় সাফল্যই বলতে হবে। সে সাফল্য পেয়েছেন মাগুরার কৃষকরা। কীট কিংবা বালাই নিধনের জন্য এখন কীটনাশকের ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন পড়ে না। প্রাকৃতিকভাবেই ফসলি জমির ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ নিধন সম্ভব।
মাগুরার বিভিন্ন মাঠে প্রাকৃতিকভাবে বালাই দমনের নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে এ রকমই মন্তব্য করছেন কৃষি বিভাগ ও কৃষি উন্নয়নে কর্মরত সংশ্লিষ্টরা।
জেলার বিভিন্ন এলাকার ক্ষেত ঘুরে দেখা গেছে, তিন ধরনের প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বালাই নাশে স্থানীয় কৃষকরা এখন অনেকটাই সফল। যার প্রথম পর্যায়ে রয়েছে মাছিপোকা দমনে ফেরোমন ট্রাপের ব্যবহার। ফেরোমন ট্রাপের পরই রয়েছে ফসলি জমি বিশেষ করে ধানক্ষেতে লাইভ পার্চিং ও ডেথ পার্চিংয়ের ব্যবহার এবং বন্ধু পোকার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন।
ফেরোমেন ট্রাপ: মনোসেক্স ফেরোমেন ট্রাপ হচ্ছে মাছি জাতীয় পোকা দমনের এক ধরনের ফাঁদ। সবজিসহ ফসলি ক্ষেতে প্লাস্টিকের বয়াম স্থাপন করে তার মধ্যে ডিটারজেন্ট পাউডার গুলিয়ে স্ত্রী পোকার গায়ের গন্ধযুক্ত ফেরোমেন স্থাপন করা হয়। ফেরোমেনের গন্ধে পুরুষ মাছি বয়ামের মধ্যে গিয়ে ডিটারজেন্ট গোলানো পানিতে পড়ে মারা যায়। ফলে পোকার বংশ বিস্তার বন্ধ হয়ে যায়। কৃষি বিভাগ ও ইসডেফ ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গোটা জেলায় পোকা দমনে কৃষকদের মধ্যে এ পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছে।
লাইভ পার্চিং ও ডেথ পার্চিং: লাইভ শব্দের অর্থ জীবন্ত। পার্চ শব্দের অর্থ দাঁড় কিংবা অল্প উঁচু ও নিরাপদ আসন। সেক্ষেত্রে লাইভ পার্চিং অর্থ জীবন্ত দাঁড়। অন্যদিকে একইভাবে ডেথ পার্চিং অর্থ দাঁড়াচ্ছে মৃত কিংবা মরা দাঁড়। দাঁড় শব্দের সঙ্গে উড়ন্ত পাখির সম্পর্ক রয়েছে। এই দাঁড়ের সঙ্গে ধানিজমির পোকা দমনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। অতীতে কৃষকরা ধানিজমিতে পাখিদের জন্য কৃত্রিম দাঁড় তৈরি করত। তখন যে কোনো ধানক্ষেতের দিকে তাকালে গাছের মরা ডাল দিয়ে পাখিদের দাঁড় স্থাপনের দৃশ্য খুব সহজে চোখে পড়ত। দাঁড় স্থাপনের লক্ষ্য ছিল একটিই, পাখিদের সহজে বসার ব্যবস্থা করা, যাতে মাজরা পোকাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকা তারা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। রাসায়নিক কীটনাশকের দাপটে এ প্রাকৃতিক কীট দমন পদ্ধতিটি হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খুশির সংবাদ হচ্ছে, এখন কৃষি বিভাগের উদ্যোগেই কৃষকদের নতুন করে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে প্রাকৃতিক পোকা দমন পদ্ধতি ব্যবহারে। যে কারণে জেলার সর্বত্র চলতি আউশ-আমন মৌসুমে অধিকাংশ ধানক্ষেতে কৃষকদের এ দাঁড় পাততে দেখা যাচ্ছে। পার্চিং পদ্ধতির দুটি ভাগ রয়েছে। এর একটির নাম দেওয়া হয়েছে লাইভ পার্চিং, অন্যটি ডেথ পার্চিং। লাইভ পার্চিং পদ্ধতিতে ধানক্ষেতে ৩ মিটার দূরত্বে পাখিদের বসার জন্য রোপণ করা হচ্ছে ধনচে গাছ।
কৃষি বিভাগের মতে, ধনচে গাছ একটু বড় হলেই সেখানে পাখিরা খুব সহজে বসতে পারে। এটি আগাছা না হওয়ায় ক্ষেতের কোনো ক্ষতি করে না। ধনচে গাছ রাইজোডিয়াম জাতীয় ব্যাকটেরিয়া থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে মাটিতে সরবরাহ করে। ফলে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় কম। যেহেতু ধনচে গাছ জীবিত অবস্থায় পাখির মাধ্যমে পোকা দমনে দাঁড় হিসেবে কাজ করছে সুতরাং এর দ্বৈত সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
অন্যদিকে ডেথ পার্চিং হচ্ছে মরা গাছের ডাল মাঠের মধ্যে পুঁতে দিয়ে একইভাবে পাখিদের বসার জায়গা করে দেওয়া। এ পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রতি বিঘা জমিতে ১০ থেকে ১২টি ডাল পুঁতে দিলেই হয়। এক্ষেত্রে কেউ কেউ ডালপালার পরিবর্তে শক্ত পাটকাঠি মাঠের মধ্যে পুঁতে দিয়ে পাখি বসার সাময়িক ব্যবস্থা করে দেন।
বন্ধুপোকা: সব পোকাই ফসলি ক্ষেতের জন্য ক্ষতিকর নয়। শস্যের ক্ষতিকারক পোকার পাশাপাশি রয়েছে কিছু বন্ধুপোকা। বন্ধুপোকা নানাভাবে শক্র পোকা দমন করে ফসলি ক্ষেতে বন্ধু হিসেবে কাজ করে। যে কারণে এদের বলা হয় বন্ধুপোকা। কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে আমাদের জীববৈচিত্র থেকে ক্ষতিকর পোকার সঙ্গে সঙ্গে দিন দিন বন্ধুপোকাও হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে ফসলের ক্ষেতে এখন বন্ধুপোকার সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আর এ প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় রেখেই মাগুরা সদর উপজেলার শ্রীকুন্ডিী গ্রামে প্রায় ১০০ একর সবজির ক্ষেতে বন্ধুপোকা ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছে ইসডেপ কনসার্ন ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তারা দেড় মাসে এ এলাকার বেগুন, চালকুমড়া, পটল, শসাসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেতে প্রায় ১৪ লাখ বন্ধুপোকা ছেড়েছে।
সংস্থার নির্বাহী পরিচালক গাউছুল আযম স্বাধীন জানান, তারা শ্রীকুন্ডী এলাকার ১০০ একর জমিতে ৫০ হাজার আইব্রাকন ও ১৩ লাখ ট্রাইকোগ্রামাথ এ দুই জাতীয় বন্ধুপোকা ছেড়েছেন। এছাড়া লেডি বার্ড ব্রিটল নামে আরেক জাতীয় পোকা ছাড়া হয়েছে। আইব্রাকন জাতীয় বন্ধুপোকা মাজরা জাতীয় ক্ষতিকর পোকার শরীরে তাদের আল ফুটিয়ে ওই পোকার জীবনশক্তি নিঃশেষ করে দেয়, যা ফসলি জমিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে ট্রাইকোগ্রামা জাতীয় বন্ধুপোকা একই পদ্ধতিতে সবজির ডগা ছিদ্রকারী ক্ষতিকর মাজরা পোকার ডিম নষ্ট করে দেয়। ফলে তাদের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হয়। এ পোকা ছাড়ার ফলে উপকৃত হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা।
তিনি আরও জানান, এ পদ্ধতিতে পোকা দমন করলে ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এতে খরচ যেমন বাঁচে, তেমনি মৌমাছি জাতীয় পরাগায়ন সহায়ক পতঙ্গ সবজি মাচায় খুব সহজে চাক বাঁধে। আর তার ফলে পরাগায়ন ভালো হওয়ায় ফলনও ভালো হয়। ইসডেপের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এসপিজিআর প্রকল্পের সহায়তায় তাদের ল্যাব থেকে প্রথমে ডিম সংগ্রহ করে আনছেন। পরে এ ডিম নিজেদের ল্যাবে দু’দিন রেখে পোকার জন্ম হলে পোকাভর্তি বয়ামগুলো কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করছেন। এছাড়া এ বিষয়ে কৃষকদের দিচ্ছেন যথাযথ প্রশিক্ষণ।
এ ব্যাপারে মাগুরা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ফসলের ক্ষেতে ফেরোমেন ট্রাপ ও বন্ধুপোকার মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকা দমন কার্যক্রম ইসডেপের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ১০টি প্রদর্শনী খামারে পরীক্ষামূলকভাবে সরকারি পর্যায়ে প্রথমবারের মতো বন্ধুপোকা ছাড়া হয়েছিল, যা থেকে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। সরকারিভাবেই এ কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক জানান, জেলায় এ বছর ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষ হয়েছে, যার মধ্যে ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে ডেথ পার্চিং ও লাইভ পার্চিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। আগামী মৌসুমে শতভাগ ধানিজমি এ পদ্ধতির আওতায় আনা হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৮জানু২০২০