কুমিল্লার শিক্ষিত নাজমার টার্কি খামার

940

01

হালিম সৈকত, কুমিল্লা থেকে: কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই, চান্দিনা এবং বুড়িচং গড়ে ওঠেছে সম্ভাবনাময় টার্কি কৃষিশিল্প। কুমিল্লায় প্রথম এই টার্কি ফার্ম শুরু করেন লালমাই উপজেলার মো. নুরুল আমিনের বড় মেয়ে নাজমা আক্তার। সে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে এই বিষয়ে বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে টার্কি ফার্ম শুরু করেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছুটোছুটি করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ইন্টারনেট থেকে টার্কি সম্পর্কে তথ্য জেনে ছোটভাই ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল হুদা অনিককে দিয়ে ভারত থেকে প্রথম অবস্থায় ১২টি টার্কি কিনে শুরু করেন ফার্ম। পুঁজি কেবল ৩০ হাজার টাকা। বর্তমানে তারা তিন উপজেলায় ৩টি টার্কি ফার্ম গড়ে তুলেছেন। এন আমিন এগ্রো ফার্ম নামে নাজমাই প্রথম পুরো কুমিল্লা জেলায় প্রথম এই টার্কি শিল্প গড়ে তোলেন।

নাজমারা তিন বোন ও এক ভাই সবাই এই টার্কি ফার্মের সাথে জড়িত। সবার ছোট ফাতেমা আক্তার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে মাস্টাসের ছাত্রী। পড়াশোনা আর টার্কির দেখাশোনা করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই তার। কথা প্রসঙ্গে ফাতেমা জানালেন চাকরির আশা করি না। বাংলাদেশে এমনিতেই বেকারত্বের হার বেশি। তাই নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলেছি। প্রতি মাসে তার আয় ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা প্রায়।

বর্তমানে লালমাই ফার্মে ছোট বড় মিলিয়ে টার্কি আছে ৫৫০টি। প্রতিনিয়িত টার্কির উৎপাদন বাড়ানো চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে জানালেন ফাতেমার বাবা নুরুল আমিন। তিনিসহ তারা পরিবারের সবাই এই টার্কি শিল্পের সাথে জড়িত। তাদের অন্য কোন কাজ নেই সারদিন শুধু টার্কির সময়মত খাবার দেওয়া, ডিমে তা দেয়ার জন্য মেশিনের তাপমাত্রা ঠিক রাখা এইসব করেই তাদের দিন কেটে যায় বেশ। তারা মূলত অনলাইন বাজরে এই টার্কির মাংস বিক্রি করে থাকেন।

কীভাবে বাচ্চা হয় এই প্রশ্নে ফাতেমা জানালেন, প্রথম প্রথম দেশি মুরগির মাধ্যমে পরে ইনকিউবেটরে এবং বর্তমানে ছোট ভাই অনিকের উদ্ভাবিত মেশিনে বাচ্চা ফুটান। এক সাথে প্রায় ১৩০০ ডিম দেওয়া হয় মেশিনে। কিছু ডিম আবার নষ্ট হয়ে যায়। এই মেশিন আবার বাণিজ্যিকভাবে সেলও করা হয়। তাদের এই ফার্মে বর্তমানে ১৭-১৮ জন লোক কাজ করেন। প্রত্যকের বেতন গড়ে ৮০০০ টাকার মতো।

003

এই টার্কির খাবার কি ধরনের? তিনি জানালেন, ভেরি সিম্পল, সবজি, ঘাস, কলমি, কচুরিপানা এবং বয়লার স্টেটা ফ্রি। টার্কি বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে মানানসই এবং উপযোগী। ২৮দিন পর্যন্ত বাচ্চা ইনকিউবেটরে রাখতে হয়। কেউ যদি ফার্ম করতে চায় তাহলে ১ মাস ৫ দিনের বাচ্চা কিনে নিতে হয়। এক জোড়া বাচ্চার দাম ১৬০০ টাকা। ২ মাসের বাচ্চা প্রতি জোড়ার বিক্রয় মূল্য ২০০০ টাকা। যদি পুরুষ মহিলা চিহ্নিত করে দেওয়া হয় তাহলে প্রতি জোড়ার মূল্য ৪০০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। ৬ মাসের মধ্যেই খাওয়ার উপযোগী হয়। ৮ মাসের মধ্যে প্রতিটা টার্কি ১০-১২ কেজি হয়।

টার্কিদের আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত। আর প্রতি কেজি টার্কির মাংস বিক্রি হয় ৫০০ টাকা জানালেন ফাতেমা ও তার বাবা। কেউ খামার করতে চাইলে প্রথমত ৩০/৫০টি দিয়ে শুরু করতে পারেন। এতে খরচ পড়বে টার্কির বাচ্চার জন্য ৪০ হাজার এবং ঘরের জন্য ৪০ হাজার মোট ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।

প্রতিদিন এই টার্কির ফার্ম দেখতে আসেন ১০ থেকে ১২ জন। যারা বড় বড় কোম্পানির এমডি কিংবা ম্যানেজার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাই আসেন-জানালেন নাজমার বাবা নুরুল আমিন।

বাণিজ্যিকভাবে কীভাবে এই ফার্ম করা যায় সেই পরামর্শ নিতেই আসেন তারা।

টার্কির মাংস পুষ্টিকর ও সুস্বাদু হওয়ায় এটি খাদ্য তালিকার একটি আদর্শ মাংস হতে পারে। পাশাপাশি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাংসের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যাদের অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস খাওয়া নিষেধ অথবা যারা নিজেরাই এড়িয়ে চলেন, কিংবা যারা গরু বা খাসীর মাংস খান না, টার্কি তাদের জন্য হতে পারে বিকল্প। তাছাড়া বিয়ে, বৌ-ভাত, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাসীর বা গরুর মাংসের বিকল্প হিসেবে টার্কির মাংস হতে পারে অতি উৎকৃষ্ট একটি খাবার এবং গরু বা খাসীর তুলনায় খরচও হবে কম।

তবে মাংস হিসেবে বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠতে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমানে ছোট আকারের খামার করার যে চাহিদা দেশব্যাপী তৈরি হয়েছে তাতে আগামী ৩/৪ বৎসরে কয়েক লাখ টার্কির প্রয়োজন হবে এবং সে ক্ষেত্রে দাম ও বেশি পাওয়া যাবে। বর্তমানে ৩০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত বয়স ও রং ভেদে টার্কির জোড়া কেনা বেচা চলছে।

002

উল্লেখ্য, টার্কি মূলত মেক্সিকো ও আমেরিকা অঞ্চলের বন্য প্রজাতির এক ধরনের পাখি। আমেরিকাতে ইউরোপীয় কলোনি স্থাপনের পূর্বে এই পাখিকে মেসোআমেরিকায় সর্বপ্রথম গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালন শুরু করা হয়। এই বন্য পাখির বহু প্রজাতি মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চলে এখনো দেখ যায়। এটি এভিস শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ফ্যাসিএনিডি পরিবারভূক্ত মিলিএগ্রিস গণের “গ্যালাপাভো ” প্রজাতির গৃহপালিত পাখি। টার্কি পাখির বাচ্চা দেখতে মুরগির বাচ্চার মতো হলেও পরিপূর্ণ বয়সে বদলে যায় আকৃতি ও চেহারা। টার্কি বাণিজ্যিক মাংস উৎপাদনের জন্য খুবই উপযুক্ত। এরা দেখতে খুব সুন্দর হয়। তবে এরা বাণিজ্যিকভাবে ডিম উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত নয়। তারা দ্রুত বড় হয়ে যায় এবং ব্রয়লার মুরগির মত খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে উঠে। পুরুষ টার্কিকে ডাকা হয় ‘টম’ নামে এবং স্ত্রী টার্কিকে ডাকা হয় ‘হেন’ নামে।সূত্র: এনবি

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন