গোল আলু কন্দাল জাতীয় সবজি ফসল। আমাদের প্রতি দিনের খাদ্য তালিকায় শর্করার চাহিদা মেটাতে গোল আলুর কোন বিকল্প নেই। গোল আলু যে কোন সব্জিতেই ব্যবহার করা যায়। গোল আলু দ্রুত পচনশীল। ক্ষেত থেকে সংগ্রহের পর অল্প সময়ের মধ্যে গোল আলুতে পচন দেখা দিতে পারে। সে জন্য বীজ হিসেবে এমনকি সারাবছরের খাবারের জন্যও সংরক্ষণ করা বেশ কঠিন হয়ে দেখা দেয়। মোট উৎপাদিত আলুর প্রায় ২০% আলু নষ্ট হয় কেবলমাত্র সংরক্ষণের অভাবে। আমাদের দেশে সাধারণতঃ কোদাল বা লাঙ্গল দিয়ে আলু সংগ্রহ করা হয়। যে কোন ভাবেই আলু সংগ্রহ করা হউকনা কেন খেয়াল রাখতে হবে যেন আলু কাটা না পড়ে বা জখম না হয়। কারণ এরূপ আলু সংরক্ষণ করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। আলু তোলার পর প্রক্রিয়াজাত করতে হয় অর্থাৎ আলুর গাদা বা লট্ হতে কাটা, যখম, রোগাক্রান্ত এবং পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত আলু সরিয়ে ফেলতে হবে। তার পর আলু বিভিন্ন গ্রেডে পৃথক করতে হবে। আলু সংরক্ষনের জন্য কোল্ডষ্টোরেজ বা হিমাগারের প্রয়োজন। আলু বীজ হিমাগেরের কাছে নিয়ে গ্রেডিং করা ভাল। আলুর ৩ টি গ্রেড আছে ১ম গ্রেড- ২৮-৩৫ মি.মি ব্যাস, ২য় গ্রেড- ৩৫-৪৫ মি.মি. ব্যাস এবং ৩য় গ্রেড- ৪৫-৫৫ মি.মি. ব্যাস। এই তিন গ্রেডের আলু আলাদা আলাদা ভাবে ছালার বস্তায় ভর্তি করে হিমাগারে সংরক্ষণ করা ভাল।
আমাদের দেশের সম্মানিত কৃষকগণ থেকে সুরু করে সাধারণ মানুষ তাঁদের নিজস্ব জ্ঞনের মাধ্যমে ঘরের মধ্যে চিলেকোঠার মধ্যে মেঝেতে, গোয়াল ঘরের মাচায়, বাঁশের টুকরি বা মাটির পাতিলে বিভিন্ন ধরনের বীজ বা শস্য দানা সংরক্ষন করে থাকেন। পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিম, বিষকাটালী ও নিসিন্দা গাছের পাতা দিয়ে সংরক্ষণ করে থাকেন।
স্বল্প আলোতে আলু সংরক্ষণের একটি আধুনিক ও সহজ পদ্ধতি আছে, এজন্য প্রথমে একটি সংরক্ষণাগার (ঘর) তৈরি করতে হবে। খুব সহজ উপকরণ ব্যবহার করে যেমন- ছন, বাঁশ, খড়, চাটাই এসব দিয়ে বাড়ির আঙিনায় বা সুবিধাজনক যে কোন স্থানে প্রয়োজন অনুযায়ী একটি সংরক্ষণাগার তৈরি করতে হবে। অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে সংরক্ষণাগারে যাতে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকে। টিনের ঘর সূর্যের তাপে দ্রুত উত্তপ্ত হয়, সেজন্য টিন দিয়ে এ ঘর তৈরি করা যাবে না। ঘর তৈরির পর আলু রাখার জন্য ঘরে দুই হাত পর পর একটি মাচান বা তাক তৈরি করতে হবে। প্রতিটি তাকের উপর চাটাই বিছিয়ে মাটি দিয়ে লেপে দিতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে আলো প্রবেশের ব্যবস্থা থাকতে হবে কিন্তু খোয়াল রাখতে হবে যাতে সূর্যের আলো সরাসরি প্রবেশ করতে না পারে।
মেঘলা বা বৃষ্টির দিনে জমি থেকে আলু তোলা ঠিক হবে না। সকালের দিকে জমি থেকে আলু তোলতে হবে। আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে পরিপক্ক হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে দিতে হবে এবং ১০ দিন পর আলু তুলতে হবে। এতে আলুর ফলন বাড়ে, আলুর চামড়া মোটা হয়, আদ্রতা কমে আসে। আলু তোলার পর ভালো করে পরিস্কার করে শুকিয়ে বাছাই করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ছায়াযুক্ত ঠান্ডা স্থানে আলু সংরক্ষণ করতে হবে। আলু তোলার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোদাল বা লাঙ্গলের আঘাতে আলু কেটে না যায়। আলু তোলা শেষ হলে জমি থেকে পরিবহণের জন্য চটের বস্তা ব্যবহার করা ভাল। বস্তায় আলু ভরার সময় প্লাষ্টিকের ঝুড়ি বা গামলা ব্যবহার করা ভাল। যদি বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করতে হয় তবে ঝুড়ির মাঝখানে চট বা ছালা বিছিয়ে সেলাই করে নিতে হবে। জমি থেকে আলু তোলার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে নিতে হবে। যদি কোন কারণে আলু ক্ষেতে রাখতে হয় তবে ছায়ার মধ্যে রাখতে হবে এবং পাতলা কাপড় বা খড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। বাড়িতে এনেও আলু পরিস্কার, শুকনো ছায়াযুক্ত জায়গায় রাখতে হবে। আলু ঢালার সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে বেশি উঁচু থেকে বেশি জোরে আলু ঢালা না হয়। আলু সংগ্রহ করার পর ৭ দিন পরিস্কার ঠান্ডা জায়গায় বিছিয়ে রেখে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে ‘কিউরিং’ করতে হবে। এতে করে আলুর গায়ের ক্ষত সেরে যায় ও পোকার আক্রমণ থেকে সংগৃহীত আলু রক্ষা পাবে। এভাবে আলু রেখে দেওয়ার পদ্ধতিকে আলু কিউরিং বলে। আলু সংরক্ষণ করার আগে কাটা, সবুজ, রোগাক্রান্ত আলু বাছাই করে আলাদা করে নিতে হবে। আলু সংগ্রহের ৭-১০ দিনের মধ্যে পরিস্কার করে আকার অনুযায়ী বড়, মাঝারি ও ছোট এভাবে গ্রেডিং করে নিতে হবে। তার পর তৈরিকৃত সংরক্ষণাগারে আলু সংরক্ষণ করতে হবে। সংরক্ষিত আলু ১০-১৫ সে.মি. অর্থাৎ ৬ ইঞ্চি পরিমান উঁচু করে বিছিয়ে রাখতে হবে। সংরক্ষিত আলু নিয়মিত বাছাই করতে হবে। রোগাক্রান্ত, পোকাধরা ও পচা আলু দেখা মাত্র আলাদা করতে হবে। আলুতে সুতলি পোকা দেখা দিতে পারে, পোকা দেখা গেলে সংগে সংগে সংগ্রহ করে অনেক দূরে গর্ত করে পুতে ফেলতে হবে।
আলু ভালোভাবে শুকানের পর সংরক্ষণাগারের তাকে রাখতে হবে। সংরক্ষণাগারে রাখা আলুর স্তর অতিরিক্ত পুরু করা যাবে না। প্রতি মাসে বাছাইকালে সংরক্ষিত আলুকে ওলট-পালট করে দিতে হবে। এ সময় পচা ও ক্ষতিগ্রস্থ আলু বাছাই করে ফেলে দিতে হবে। তা না হলে ক্ষতিগ্রস্থ আলুর রোগবালাই ভালো আলুকেও সংক্রমিত করতে পারে। সংরক্ষণাগারে যাতে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করে সে দিকে নজর রাখতে হবে। তবে সূর্যের আলো যাতে সরাসরি প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। “আ.ন.ম বোরহান উদ্দিন ভূঞা”