অর্থনীতির বিশাল অংশ জুড়ে আছে কৃষি। দেশের অধিকাংশ মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। ২০১৮ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, এটি মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ জোগান দিয়ে থাকে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান ১৪.১০ শতাংশ।
রাষ্ট্রের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এই খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৪র্থ, সবজি উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, চা উৎপাদনে ৪র্থ, পাট রপ্তানিতে ১ম অবস্থানে আছে।
দিন দিন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের কৃষি ব্যবস্থা। কিন্তু সম্ভাবনা আর বিজয়ের মাঝেও এই সেক্টরের মূল কারিগর দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষি ক্ষেত্র দিয়ে লাভ করে নিচ্ছে হোমরাচোমরারা। কিন্তু গরিব কৃষক প্রান্তিক পর্যায়েই থেকে যাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ফসলের দাম।
কৃষক এত কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করে কিন্তু বিক্রি করে সেই উৎপাদন খরচই ওঠে না। কিছুদিন আগেই দেখা গেল ধান কাটার শ্রমিকের মূল্যের চেয়ে ধানের দাম কম হওয়ায় ধানক্ষেতে আগুন দিয়েছে কৃষক। এর চেয়ে হৃদয় বিদারক দৃশ্য আর কিছুই হত পারে না। কিন্তু এই কৃষকের হাত দিয়ে যখন ফসল বের হয়ে যায় তখনই এর দাম তরতর করে বাড়তে থাকে। আর এটা যখন একদম খাদ্য হিসেবে বাজারে আসে তখন মূল্য হয়ে যায় আকাশচুম্বী। এর পিছনে কাজ করে বিভিন্ন সিন্ডিকেট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছিল খাদ্য নিয়ে। তাই এরপর থেকে তারা কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্য দিয়ে ফসল কেনে। কারণ কৃষক চাষাবাদ বন্ধ করে দিলে খাদ্যের অভাব দেখা দিবে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুড়ি ভুড়ি। আর তেল মাথায় সবাই তেল দেয়। দিনশেষে যারা গরিব তারাই গরিব থেকে যায়, ধনবানরা দিন দিন ধনী হতেই থাকে। তা তারা ধনী হোক তাতে আপত্তি নাই কিন্তু গরিবের পেটে কেন লাথি মারতে হবে? ধানের দাম ১২ টাকা আর চালের দাম সর্বনিম্ন ৪০ টাকা। মাঝখানের টাকাগুলো কাদের পকেটে যায়? কৃষক তো তার খরচ ওঠানোর দামটুকুও পায় না।
সবজি উৎপাদনে আমরা বিশ্বে তৃতীয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সবজি রপ্তানিতে আমাদের অবস্থান একদমই খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো। আর পিছনে দায়ী কারা? যারাই দায়ী হোক না কেনো, কৃষিক্ষেত্রে যাদের সবচেয়ে বেশি অবদান তারাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত। কৃষকের সমস্যা কিংবা সুবিধা অসুবিধা নিয়ে ভাবার লোকের বড়ই অভাব। কৃষি উপকরণ কৃষক বাজার থেকে ক্রয় করে আনে।এই সমস্ত উপকরণের ক্ষেত্রে মূল্য নিচ থেকে আস্তে আস্তে উপরে উঠতে থাকে। যেখান থেকে সরাসরি উৎপাদিত হয় তার সাথে কৃষকের দেয়া মূল্যের আকাশ পাতাল তফাৎ। মাঝখানে সকল পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা নিজের সুবিধামতো লাভ করে নেয়, ঠকে শুধু কৃষক।
এবার আসি ফসল বিক্রির প্রসঙ্গে, ফসল উৎপাদনের পর তা যখন বাজারে বিক্রি করা হয় তখন সবচেয়ে কম মূল্য পায় কৃষক। আর আস্তে আস্তে মূল্য বাড়তে থাকে। এ ক্ষেত্রেও আকাশ আর পাতাল থাকে তফাৎ। এমনকি কৃষকের উৎপাদিত জিনিসই অন্য কৃষকের চড়া মূল্য দিয়ে কিনতে হয়। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কয়েক হাত ঘুরে ভোক্তার হাতে যায়। এই কারণে কৃষক সবচেয়ে কম মূল্যটা পায়।
উৎপাদিত ফসল যখন বাজারে আসে তখন ব্যবসায়ীরা কোনো রকম একটা দাম দিয়ে তা কিনে নেয়। এগুলো মজুদ করে রেখে পরবর্তীতে বাজারে যখন পণ্যের ঘাটতি দেখা যায় তখন এগুলো চড়া দামে বিক্রি করে। এই সমস্যা বেশি হয় ধানের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশ ধান উৎপাদনে পৃথিবীতে চতুর্থ, তাই প্রচুর পরিমাণ ধান উৎপন্ন হয় আমাদের দেশে কিন্তু কৃষকের হাতে সঠিক মূল্যটা আসে না। তাই এই ধরনের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা দরকার।
ধান কম দামে কিনে সেই ধান মজুদ করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তা বিক্রি করছে চড়া দামে। ন্যায্যমূল্য তো দূরে থাক উৎপাদনের খরচটুকুও ওঠে না কৃষকের। সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে কৃষক বাঁচানো জরুরি।
আবার কৃষি উপকরণের ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসার মিথ্যা বলে অনেক সময় মানহীন বীজ কিংবা অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করে যাতে করে কৃষক ক্ষতির স্বীকার হয়। এদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্যান্য কারণে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষক এজন্য কোনো সাহায্যও পায় না। তাই ফসল বীমাও জরুরি একটা বিষয়।
এবার আসি অনুদানের ব্যাপারে, অনুদান যে আসে না তা না। অনুদান আসে কিন্তু কৃষকের হাত পর্যন্ত পৌঁছায় খুবই কম। কৃষকের প্রয়োজন আছে কিন্তু লোভ নেই তবে যাদের প্রয়োজন নেই কিন্তু লোভ আছে তারাই ভোগ করে বেশি। যারা কৃষক তারা সাধারণত অনেক সহজ সরল প্রকৃতির হয়। তারা মানুষকে সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে।
যার যখন ব্যবসার কাজে লাগে সে তখন বড় বড় স্লোগান দেয় যে আমরা কৃষকের স্বার্থে কাজ করছি। কিন্তু কৃষকের সুখ-দুঃখ ভাবার কেউ নাই। যাদের হাতে দেশ গড়ে তাদের পেটেই যদি লাথি পড়ে, দেশের তবে কি হবে ?
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ