রংপুর: আধুনিক ফিড মিল, হ্যাচারি এবং পোল্ট্রি খামার স্থাপনের দিক থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে রংপুর বিভাগ। এ উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে আগামী দশ বছরে রংপুরের পোল্ট্রি লিড করবে বলে মন্তব্য করেছেন পোল্ট্রি খামারি এবং শিল্প উদ্যোক্তারা।
সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত পোল্ট্রি রিপোর্টিং বিষয়ক মিডিয়া কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে এমন দাবি করেন তারা।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সহযোগিতায় কর্মশালাটি আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা ওয়াচডগ বাংলাদেশ।
এতে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক, বার্তা সংস্থা এবং টেলিভিশন চ্যানেলের মোট ৩০ জন সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি রংপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, পোল্ট্রি শিল্প না থাকলে দেশের মানুষের ডিম ও মুরগির মাংসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ছিল না।
তিনি বলেন, পোল্ট্রি একটি নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর ফলে শুধু প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণই নয় বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের দারিদ্রতা ঘুচেছে। আগামী দিনের চাহিদা মেটাতে একদিকে যেমন বাণিজ্যিক উৎপাদন বাড়াতে হবে অপরদিকে তেমনি ক্ষুদ্র খামারিদের সুরক্ষার কথাও ভাবতে হবে।
রংপুরের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাহাবুবুল আলম বলেন, রংপুরের পোল্ট্রি এখন আঞ্চলিক গন্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় চাহিদা পূরণে কাজ করছে। রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও জেলায় গত ১০ বছরে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে দিয়েছে। রংপুর জেলায় ডিমের উৎপাদন ৬২ কোটি ৩৯ লাখ। মাংসের উৎপাদন ১.১৯ লাখ মেট্রিক টন। ডিমের মাথাপিছু কনজাম্পশন প্রায় ১০১টি এবং মাংসের কনজাম্পশন প্রায় ১২১ গ্রাম।
প্রাণিসম্পদ অফিস বলছে, এ বিভাগে মুরগির খামার রয়েছে ছয় হাজার ১৩৯টি। এর মধ্যে লেয়ার মুরগির খামার দুই হাজার ৩৭৯টি এবং ব্রয়লার মুরগির খামার তিন হাজার ৭৬০টি। এতে মোট মুরগির সংখ্যা দুই কোটি ৮৮ লাখ এক হাজার ৭৭৯টি। গত অর্থবছরে ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৪৩ কোটি পিস। উৎপাদন হয়েছে ১৪০ কোটি পিস। ১০ বছর আগে উৎপাদন ছিল ১০ ভাগের এক ভাগ। বিভাগের এক কোটি ৫৫ লাখ মানুষের মাংসের চাহিদা ছয় লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ছয় লাখ দুই হাজার মেট্রিক টন।
রংপুর পোল্ট্রি শিল্প মালিক সমিতি’র যুগ্ম-সচিব মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, জুন-জুলাই মাসে ডিমের বাজারে যে ধস নেমেছিল তা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে ক্ষুদ্র খামারিদের জন্য কৃষির মতোই সাবসিডাইজড রেটে বিদ্যুৎ বিল এবং নূন্যতম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, পোল্ট্রি শিল্পের কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেয়া সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি কারণ এ শিল্পের ভিত এখনও বেশ নরম অবস্থায় আছে। আর সে কারণেই কর ও শুল্কের চাপ সইতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গ্রাম-গঞ্জের অসংখ্য খামার।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি অ্যান্ড পোল্ট্রি সায়েন্স বিভাগের প্রফেসর ড. তাহেরা ইয়াসমিন বলেন, পোল্ট্রি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক ভুল ধারণা আছে অথচ সবচেয়ে নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে পোল্ট্রি’র ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদন করা হয়। নকল ডিম নিয়ে অনেক প্রচারণা হয়েছে কিন্তু দেশে নকল ডিমের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দেশের মানুষের পুষ্টির স্বার্থে এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধ করে ইতিবাচক প্রচারণা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন ড. তাহেরা।
দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম-সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, গণমাধ্যমের প্রতি দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেই শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহযোগী হিসেবেও গণমাধ্যম কাজ করছে। নকল ডিম সম্পর্কে গণমাধ্যম যেমন ভোক্তাদের উৎকণ্ঠা তুলে ধরেছে তেমনি আবার এর গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করে জনমনের শংকা ও বিভ্রান্তিও দূর করেছে।
যমুনা টেলিভিশনের বিজনেস এডিটর সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, পোল্ট্রি শিল্পে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে, প্রায় ২০ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তাই স্বাভাবিক কারণেই পোল্ট্রি এখন মফস্বল সংবাদের গন্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় এবং বিজনেস নিউজের কনটেন্ট হয়ে উঠেছে। তবে আমাদের দেশে পোল্ট্রি বিষয়ক রিপোর্টিং এর বিষয়বস্তু ও মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরও মনোযোগ দিতে হবে। তথ্যের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের সাথে পোল্ট্রি বিষয়ক তথ্যের আদান প্রদান আরও বাড়াতে হবে।
বিপিআইসিসি’র মিডিয়া উপদেষ্টা মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, পৃথিবী জুড়ে পোল্ট্রি বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি এবং মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদার পাশাপাশি রুচির ভিন্নতা আনার ক্ষেত্রে পোল্ট্রি শিল্পের যে বিকাশ তার যত সামান্যই আমাদের মিডিয়ায় উঠে আসছে। পোল্ট্রি রিসাইক্লিং কিংবা পোল্ট্রিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রভৃতিগুলো বিষয়গুলো মিডিয়ার দর্শক-পাঠকের জন্যও আগ্রহোদ্দীপক হতে পারে।
কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মাঝে উপস্থিত ছিলেন, প্যারাগন গ্রুপের এজিএম (মার্কেটিং) মো. রফিকুল ইসলাম, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেডের জিএম (সেলস) সাইর বীন আহম্মদ রুশো, অ্যাসিট্যান্ট ম্যানেজার ডা. অনুকূল চন্দ্র সেন এবং সিনিয়র জোনাল ম্যানেজার রঞ্জিত কুমার রায়।
কর্মশালা শেষে অংশগ্রহণকারি সাংবাদিকদের হাতে সনদপত্র তুলে দেন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান। পোল্ট্রি রিপোর্টিং প্রতিযোগিতার বিজয়ী হিসেবে প্রথম পুরস্কার জিতে নেন চ্যানেল আই এর জেলা প্রতিনিধি মেরিনা লাভলী, দ্বিতীয় হন ডিবিসি নিউজের জেলা প্রতিনিধি রতন সরকার, তৃতীয় হন বৈশাখী টিভি’র মুহাম্মদ আফতাব হোসেন, চতুর্থ হন চ্যানেল-২৪ এর নাজমুল ইসলাম নিশাত, পঞ্চম হন দৈনিক কালের কন্ঠের স্বপন চৌধুরি, ষষ্ঠ হন দৈনিক সমকালের ইকবাল হোসেন, ৭ম হন দৈনিক আমাদের সময় এর নজরুল মৃধা, ৮ম হন দি নিউ এজ পত্রিকার জাকির হোসেন এবং ৯ম হন দৈনিক যায় যায় দিন এর জেলা প্রতিনিধি আবেদুল হাফিজ।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম