কৃষির সুরক্ষায় করোনা শেষে যা করতে হবে

475

করোনার কারণে দেশের সিংহভাগ অঞ্চলে লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় পরিবহন ব্যবস্থা মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। দুর্যোগের এ সময়ে সরকারের উচিত সার, বীজ, কীটনাশক বা বালাইনাশকের যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্য যেন কৃষক ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। নয়তো প্রান্তিক কৃষক একসময় ফসল উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। কৃষি ঋণে সুদ মওকুফসহ বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে বীজ, কীটনাশক সরবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহয়তার ব্যবস্থা করতে হবে।

করোনা পরবর্তী করণীয়: করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের পাঁচ বাছর বা দশ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় উন্নত দেশ থেকে ঋণ পাওয়ার সম্ভবনা কমে যাবে। ফলে দেশীয় সীমিত সম্পদের ব্যবহার করে কিভাবে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জিত হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কৃষি, প্রাণিজ সম্পদ এবং মৎস্য সম্পদ বিভাগের সমন্বিত পরিকল্পনায় দেশের কৃষি খাত ফিরে পেতে পারে তার হারানো গৌরব। সংকট মোকাবেলায় নিচের পদক্ষেপগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে-

• সরকার করোনা পরবর্তী কৃষির ঘাটতি মোকাবেলায় ৫০০০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কৃষকদের মাঝে সহজ শর্তে প্রদত্ত ভর্তুকি যেন প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিনা মূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি ভর্তুকি প্রাপ্তি সহজ করতে হবে। প্রয়োজনে আগের ঋণের সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত বিবেচনা করতে হবে।

• সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সেচ কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতে ভর্তুকি দিতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করে সবাইকে সেচ সুবিধার আওতায় আনতে হবে। বিএডিসির সেচ প্রকল্প সম্প্রসারণ করতে হবে। গ্রাম ভিত্তিক গভীর নলকূপ স্থাপনে সরকারি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

• আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষককে দক্ষ করে তুলতে হবে। করোনায় শ্রমিক সংকট মোকাবেলায় বীজ বপন, ধান মাড়াই বা ফসল কর্তনের আধুনিক যন্ত্রগুলোর ব্যবহারে অভ্যস্ত করতে তুলতে হবে। সরকার প্রতিটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টরের উপর পনেরো লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে। এসব যন্ত্রের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

• কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। সঠিক প্রক্রিয়াজাত করণের অভাবে দেশের এক পঞ্চমাংশ উৎপাদিত ফল ও সবজি নষ্ট হয়। জ্যাম, জেলি বা সস জাতীয় পণ্য উৎপাদনে আগ্রহী করতে বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনে ভর্তুকিসহ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের সহজ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

• প্রধানমন্ত্রী এবার খাদ্য ঘটতি পূরণের লক্ষ্যে পতিত জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের উপর জোর গুরুত্বারোপ করেছেন। বসত বাড়ির আশেপাশে, জমির আইলে, রাস্তা-বেড়ি বাঁধের ধার, পুকুরপাড়সহ সব জমি উৎপাদনের আওতায় আনতে হবে। বরিশাল, সিলেট বা পার্বত্য চট্টগ্রামের অনাবাদি জমিগুলোকে চাষের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এক ফসলি জমি সম্ভব হলে সেচ সুবিধার আওতায় এনে দুই বা তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করতে হবে।

• প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা গুরুত্বের সাথে প্রচার করতে হবে। জলোচ্ছ্বাস, বন্যা বা খরা মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। হাওর এলাকায় হড়কাবানে যেন ফসলহানী না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামত, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের পুনর্নির্মাণ, পুরাতন দুর্বল বাঁধের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার লক্ষ্যে দখল হওয়া নদী-খাল পুনর্খননের ব্যবস্থা করতে হবে। সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূপৃষ্টস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

• নগদ লাভের লোভে বর্তমানে কৃষি জমিগুলো মাছ চাষের জন্য খনন করে পুকুর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্থকরী ফসল হিসেবে ফুল চাষ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বেশি মুনাফা হওয়ায় অনেক অঞ্চলের কৃষক দিন দিন তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। স্বাভাবিক অবস্থায় এসব পদক্ষেপ ধীরে ধীরে খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দুর্যোগকালীন প্রয়োজনে কঠোর আইন করে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ চাষাবাদ বন্ধ করতে হবে।

• সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুবিধা প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে পৌঁছাতে নির্ভুল ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ন্যায় কৃষক কার্ড তৈরি করে সরকারি সিদ্ধান্তের সুফল তৃণমূলে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

• অনুৎপাদনশীল খাতগুলো চিহ্নিত করে, এসব খাতে ব্যবহৃত জনশক্তি উৎপাদনশীল খাতে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রিকশাচালক, ভিক্ষুক, ফেরিওয়ালা প্রভৃতি পেশায় নিয়জিত জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে উৎপাদনমুখী খাতে সম্পৃক্ত করতে হবে।

• আমদানি নির্ভর বীজ সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বিএডিসিসহ দেশীয় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

বৈশ্বিক এ দুর্যোগ যেমন জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি অর্থনৈতিক মন্দা খাদ্য নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ একটি সীমিত সম্পদের জনবহুল দেশ। পরিকল্পিত পদক্ষেপে এই বিশাল জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে না পারলে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে যাবে। বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখার কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সমন্বিত কার্যক্রমই পারে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের মতো দুর্যোগ এড়াতে। সমন্বিত কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক কৃষি খাতকে ঢেলে সাজানোর এখনই উপযুক্ত সময়।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৯এপ্রিল২০