শস্য, মাছ ও প্রাণিসম্পদের অনেক তথ্যই এই শুমারিতে যোগ করা হয়নি। সরকারের যেকোনো নীতি-কৌশল প্রণয়নে বিশুদ্ধ ও নির্ভরশীল তথ্য দরকার। সেটি নিশ্চিত করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদি যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা কঠিন বলে বর্তমান কৃষিশুমারি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন সরকারের দুজন সচিব।
গতকাল রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবন মিলনায়তনে কৃষিশুমারির ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে কৃষিসচিব মোহাম্মদ নাসিরুজ্জামান এবং মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব রইছউল আলম মণ্ডল কৃষিশুমারি নিয়ে এই সমালোচনা করেন।
এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনিও কৃষিশুমারির ভুলত্রুটি অস্বীকার করেননি। মন্ত্রী বলেন, ‘সবার কথা বলার, মত প্রকাশ করার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় বর্তমান সরকার। কৃষিশুমারির ভুলত্রুটির কথা অস্বীকার করব না। কথা দিচ্ছি, আগামীতে যেসব জরিপ-শুমারি হবে, সেখানে ভুলত্রুটি দূর করার সর্বোচ্চ চেষ্টাই থাকবে আমাদের।’ তিনি আরো বলেন, ‘কৃষিশুমারিতে অনেক অপ্রচলিত ও উঠতি ফসল বাদ পড়েছে। এটা ঠিক। আমাদের উদ্দেশ্য একটি নিখুঁত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য দেওয়া।’ যেসব বিষয় বাদ পড়েছে আগামী দিনে তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন মন্ত্রী।
দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কত, কৃষিকাজের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততার হার কত, ভূমির ব্যবহার—এসব তথ্য জানতে ১০ বছর পর গত ৯ জুন সারা দেশে একযোগে কৃষিশুমারির কাজ শুরু করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতিটি খানা থেকে কৃষিভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হয় ২০ জুন। চার মাস পর গতকাল কৃষিশুমারি-২০১৯-এর প্রাথমিক ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ শুমারি করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৪৫ কোটি টাকা।
কৃষিশুমারির নানা অনিয়ম ও অসংগতি নিয়ে গত ১৫ অক্টোবর কালের কণ্ঠের প্রথম পাতায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বর্ষাকালে কৃষিশুমারি এবং রাজধানীতে কৃষিশুমারি করা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। একই সঙ্গে কৃষিশুমারির প্রশ্নপত্রের নানা অসংগতি নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। গতকাল কৃষিশুমারির ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানেও একই ধরনের মন্তব্য করলেন সরকারের দুই সচিব।
অনুষ্ঠানে কৃষিশুমারির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক জাফর আহাম্মদ খান।
এই শুমারির ওপর আলোচনা করতে গিয়ে কৃষিসচিব মোহাম্মদ নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘তথ্য নিয়ে বিবিএসের সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রায় সময় বিরোধ তৈরি হয়। সারা দেশে আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে আমরা গত অর্থবছর আমনের উৎপাদন পেয়েছি এক কোটি ৫৩ লাখ টন। কিন্তু বিবিএস বলল,
গত অর্থবছর আমনের উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখ টন। দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তথ্যের গরমিল তৈরি হলো। দেখা গেল, ১৩ লাখ টন আমন ভাসমান। এই ১৩ লাখ টন ধান হাওয়া হয়ে গেল।’ তিনি আরো বলেন, ‘কৃষিশুমারিতে আমি হাইব্রিড ধানের হিসাব থাকার প্রত্যাশা করেছিলাম; কিন্তু খুঁজে পাইনি। কতটুকু জমিতে ধান চাষ হয় তার কোনো তথ্যও নেই। অনেক জায়গায় ছাদ বাগানে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদিত হয়।
দিন দিন এই হার বাড়ছে; কিন্তু কৃষিশুমারিতে ছাদ বাগানের কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের কোনো তথ্য নেই। সারা দেশে অনেক জেলায় ভাসমান মাচার ওপর কৃষিজাত পণ্য উৎপাদিত হয়। কৃষিশুমারিতে সেই তথ্যও নেই। ড্রাগন ফলও প্রচুর উৎপাদিত হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু কতটুকু জমিতে কতটুকু ড্রাগন ফল উৎপাদিত হয়, সেই তথ্যও আসেনি কৃষিশুমারিতে। অনেক উঠতি ফসল আছে, যেগুলো কৃষিশুমারিতে বাদ পড়ে গেছে।’
সামনের দিনগুলোতে যখন কৃষিশুমারির প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়ার অনুরোধও করেন কৃষিসচিব।
মৎস ও প্রাণিসম্পদ সচিব রইছউল আলম মণ্ডল বলেন, ‘একজন মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে যা খায় এবং ঘুমানোর আগে যা খায়, তার সঙ্গে মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত। অথচ এই শুমারিতে এসব কিছুই যুক্ত করা হয়নি।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দেশে ডিমের উৎপাদন কত, তা কৃষিশুমারির প্রশ্নপত্রে যোগ করা হয়নি। দুধের উৎপাদন কত, মাছের উৎপাদন, মাংসের উৎপাদন—এসব বিষয় যুক্ত হয়নি।
মিষ্টি পানিতে কেমন মাছ উৎপাদিত হয় আবার লবণাক্ত পানিতে কত মাছ উৎপাদিত হয়, তার কোনো তথ্যই নেই কৃষিশুমারিতে। দেশের রপ্তানি আয়ের একটি অংশ আসে চিংড়ি রপ্তানি থেকে। কিন্তু দেশে এখন চিংড়ি উৎপাদন কত, তা কৃষিশুমারিতে আসেনি।
রইছউল আলম মনে করেন, বিবিএসের কাছ থেকে যদি এসব তথ্য পাওয়া না যায়, তখন অন্যের ব্যবহার করা তথ্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মনগড়া তথ্য ব্যবহার চালু হবে। সেটি ভালো হবে না।
বিবিএস তাদের কৃষিশুমারির প্রশ্নপত্রে ২৬ নম্বরে খাঁচায় মাছ চাষের অধীনে জমির যে প্রশ্নটি রেখেছে, সেটিরও সমালোচনা করেন মত্স্যসচিব। তিনি বলেন, ‘সারা দেশে কত জায়গায় খাঁচায় মাছ চাষ হয়, তা আমরা জানি। খুবই কম জায়গায়।’ তাই এই প্রশ্ন না রাখলে ভালো হতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ