উর্বর মাটিতে পাঁচ ভাগ জৈব পদার্থ থাকতে হয়। মাটির পানি ধারণক্ষমতা ও বায়ু চলাচল বাড়াতে পাঁচ ভাগ জৈব পদার্থ থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশের মাটিতে রয়েছে এক দশমিক আট থেকে দুই ভাগ। জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়াতে কম্পোস্ট সার, পচা আবর্জনা, সবুজ সারের যেমন ভূমিকা, কেঁচো সারের ভূমিকাও তেমনি অসামান্য। উর্বর মাটিতে পাঁচ ভাগ জৈব পদার্থ থাকতে হয়। মাটির পানি ধারণক্ষমতা ও বায়ু চলাচল বাড়াতে পাঁচ ভাগ জৈব পদার্থ থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশের মাটিতে রয়েছে এক দশমিক আট থেকে দুই ভাগ। জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়াতে কম্পোস্ট সার, পচা আবর্জনা, সবুজ সারের যেমন ভূমিকা, কেঁচো সারের ভূমিকাও তেমনি অসামান্য। তরিতরকারির ফেলে দেয়া অংশ, ফলমূলের খোসা, উদ্ভিদের লতাপাতা, পশুপাখির নাড়িভুঁড়ি হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, ছোট ছোট করে কাটা খড়কুটো খেয়ে কেঁচো জমির জন্য সার তৈরি করে। এ সার সব ধরনের ফসল ক্ষেতে ব্যবহার করা যায়।
কী আছে কেঁচো সারে: ‘ভার্মি কম্পোস্ট’ বা কেঁচোসারে মাটির পানি ধারণ করার ক্ষমতা ও মাটি নরম করার ক্ষমতা তো আছেই, এ ছাড়া আছে আটাশি দশমিক ৩২ ভাগ জৈব পদার্থ, এক দশমিক ৫৭ ভাগ নাইট্রোজেন, এক দশমিক ২৬ ভাগ বোরন-যেগুলো অন্যান্য জৈব সারে এত বেশি পরিমাণে নেই। কেঁচোসার ব্যবহার করলে চাষের খরচ কম হয়। প্রাকৃতিক লাঙ্গল যে কেঁচো তারও সংখ্যা বাড়ে মাটিতে। উৎপাদিত ফসলের বর্ণ, স্বাদ, গন্ধ হয় আকর্ষণীয়। ফসলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে।
সহজ উপায়ে কেঁচোসার উৎপাদন: কেঁচোসার উৎপাদন করতে গভীর মাটিতে যে ছাই রঙের কেঁচো পাওয়া যায় সেগুলো না নিয়ে বরং মাটির ওপর স্তুরে থাকা লাল রঙের কেঁচো খুবই ভালো। এ ছাড়া সার উৎপাদনের আলাদা কেঁচোও পাওয়া যায়। কেঁচো সার উৎপাদনের জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে প্রথমে কোমর সমান গর্ত করে তাতে দুটো রিং স্লাব বসায়ে দিতে হয়। গর্তের তলায় শুকানো ঝরা মাটি দিয়ে কিছু অংশ ভরে দিতে হয়। তার ওপর বিছাতে হয় কুচি কুচি করে কাটা খড়কুটো, তার ওপর আবার ঝুরা মাটি। ঝুরা মাটির ওপর পচা আবর্জনার স্তর। আবর্জনার ওপর ঝুরা মাটির স্তুর দিতে হবে আরও একবার। এবার মুরগির বিষ্ঠার একটি স্তুর করে নিতে হয়। বিষ্ঠার ওপর আবার ঝুরা মাটি দিতে হয়। শেষের স্তরে গোবর। ঝড়-বাতাস আর বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে ওপরে দিতে হবে ছাউনি। এভাবে তিন মাস রেখে দিলেই পাওয়া যাবে কেঁচো সার। অন্যভাবেও কেঁচো সার উৎপাদন করা যায়। এ ক্ষেত্রে ছায়াযুক্ত স্থানে পলিথিন ব্যাগে আবর্জনা রেখে দিতে হয়, যাতে আবর্জনা পচতে পারে। সাত-আট দিন পর পলিথিন বিছিয়ে দুটি রিং স্লাব পরপর সাজিয়ে তার ভেতর পচা এই আবর্জনা দ্বিগুণ পরিমাণ গোবরের সঙ্গে মিশিয়ে রেখে দিতে হয়।
কেঁচো কম্পোস্ট: মাটির লাল কেঁচো খড়কুটো, ফসলের অবশিষ্টাংশ, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট এবং মাটির সমন্বয়ে যে জৈব সার তৈরি হয় তাকে বলা হয় কেঁচো কম্পোস্ট সার। এটি সহজ একটি পদ্ধতি যেখানে আবর্জনা দিয়ে ব্যবহার উপযোগী উৎকৃষ্ট জৈব সার তৈরি করা যায়। কেঁচো কম্পোস্ট সার জমির এক কোণায়, গাছের নিচে এমনকি ঘরের ভেতর বড় বাক্সে তৈরি করা যায়। খোলা জায়গায় তৈরি করতে হবে। মাটি ও জৈব আবর্জনার স্তুপের সাথে কেঁচো মেশাতে হবে। এরপর স্তুপ ঢেকে রাখতে হবে। কেঁচো দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করে এবং কয়েক মাসেই তা কেঁচো কম্পোস্ট সারে রূপ নেয়। ঘরের ভেতর বাক্সে তৈরি করতে হলে বাক্সের ভেতর পুরনো খবরের কাগজ বিছিয়ে তা পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে। তারপর জৈব মাটি বিছিয়ে দিয়ে কেঁচো ছেড়ে দিতে হবে। মাটি এবং তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে কেঁচো মারা যেতে পারে এ জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
কেঁচো কম্পোস্ট সারের উপকারিতা: এটি ব্যবহারে উৎপাদন ও ফসলের গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট ও বড় আকারের ফল বা সবজি পাওয়া যায়। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, ফলে কেঁচো সার ব্যবহারে সেচের পানি কম লাগে। ক্ষারীয় লবণাক্ত মাটিতেও চাষাবাদ সম্ভব। রোগ ও পোকা-মাকড়ের উপদ্রব কম হয়। জমিতে আগাছার প্রকোপ কম হয়। ফসলের বীজের অঙ্কুুরোদ্গম ক্ষমতা বাড়ে। অধিক কুশি, অধিক ছড়া ও দানা গঠন হয়। মাটির বুনট উন্নত হয়। রাসায়নিক সারের চেয়ে খরচ অনেক কম হয়। পরিবেশও দূষণমুক্ত থাকে। বৈশিষ্ট্য এ সারে গাছের অত্যাবশ্যকীয় ১৬টি খাদ্য উপাদানের ১০টিই বিদ্যমান। এ ছাড়া এর মধ্যে গাছের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি হরমোন ও এনজাইম রয়েছে, যা গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও ফলের বর্ণ, গন্ধ, স্বাদসহ অন্যান্য গুণগত মান উন্নত রাখে। কেঁচো সার বীজের অঙ্কুরোদ্গমে সহায়ক। এ সার ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন খরচ কমে। সব ফসলেই ব্যবহারযোগ্য। বেলে-দোআঁশ মাটিতে এর কার্যকারিতা বেশি। ফলদ গাছ বা উঁচু জমির ফসলে পর পর তিনবার কেঁচো সার ব্যবহার করলে ডিম থেকে উৎপন্ন কেঁচো ওই স্থানে নিজে থেকেই সার উৎপাদন করতে থাকে। ফলে পরবর্তী দু-তিনটি ফসলে সার ব্যবহার না করলেও চলে। পুষ্টিমান জৈব পদার্থ দিয়ে সাধারণ সার তৈরির পরিবর্তে কেঁচো সার তৈরি করলে এর পুষ্টিমান ৭ থেকে ১০ গুণ বাড়ে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারে রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর মধ্যে জৈব পদার্থ ২৮ দশমিক ৩২ ভাগ, নাইট্রোজেন ১ দশমিক ৫৭ ভাগ, ফসফরাস ১ দশমিক ২৬ ভাগ, পটাশিয়াম ২ দশমিক ৬০ ভাগ, ক্যালসিয়াম ২ ভাগ, ম্যাগনেসিয়াম দশমিক ৬৬ ভাগ, সালফার দশমিক ৭৪ ভাগ, আয়রন ৯৭৫ পিপিএম, ম্যাংগানিজ ৭১২ পিপিএম, বোরন ০.০৬ ভাগ, জিঙ্ক ৪০০ পিপিএম, কপার ২০ পিপিএম রয়েছে। ফ
সলে কেঁচো সারের ব্যবহার: বৃষ্টিনির্ভর ফসল তিল, মুগ ছোলা, মাষকলাই, জোয়ার, বাজরা, সরিষা এসব কম পুষ্টি চাহিদাসম্পন্ন ফসলে রাসায়নিক সার ছাড়াই একর প্রতি মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ কেজি কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। সূর্যমুখী, বার্লি, ভুট্টা ও গম এসব ফসলে কৃষকরা সাধারণত হালকা সেচ, রাসায়নিক সার ব্যবহার করে থাকে। এ ক্ষেত্রে একরপ্রতি মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
আমাদের দেশের কৃষক ভাইরা কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে কম খরচে অধিক ফলন ঘরে তুলতে পারেন। এতে জমি রাসায়নিক সারের হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং উর্বরতা বজায় থাকবে। সাবধানতা পিঁপড়া, উইপোকা, তেলাপোকা, গুবরেপোকা, মুরগি ও বিভিন্ন পাখি কেঁচোর শক্র। এগুলো কোনো কীটনাশক দিয়ে মারা যাবে না। তবে হাউসের চারদিকে কীটনাশক দেয়া যাবে। ব্যবহৃত গোবরের সঙ্গে ছাই, বালু, ভাঙা কাচ ইত্যাদি রাখা যাবে না। মুরগি ও পাখির আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য হাউসের ওপর ঢাকনা দিয়ে রাখবেন। কেঁচোকে জীবিত ও সক্রিয় রাখতে হাউসে বেশি পানি দেয়া যাবে না, আবার পানি শুকিয়ে ফেলাও যাবে না। চালনি দিয়ে চালার সময় হাউসে নির্দিষ্ট জাত ছাড়া অন্য জাতের কেঁচো থাকলে তা আর পরে সার তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে না।
লেখক: ছিদ্দিকুর রহমান শাহীন।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৫সেপ্টেম্বর২০