চাঁদপুরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছেড়ে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) সারের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। রাসায়নিক সারের ক্ষতিকারক দিক বিবেচনা করে এই জেলার কৃষকরা এখন ব্যাপক হারে ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার শুরু করেছেন। ফলে জেলার বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সারের উৎপাদন। মাটির উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে চাষে উপকারিতা পাওয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় জেলায় কৃষকরাও দিন দিন কম্পোস্ট সার ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। অনেক কৃষি উদ্যোক্তাই এখন বাণিজ্যিকভাবে এ সার উৎপাদন করছেন।
এরই মধ্যে চাঁদপুর জেলায় ১৪ জন কৃষি উদ্যোক্তা কৃষি বিভাগের পরামর্শে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করে এখন বাণিজ্যিকভাবে সার উৎপাদন করছেন। তাদের পাশাপাশি নতুনদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
জানা গেছে, জমিতে অতিমাত্রায় বালাইনাশক, আগাছানাশক, কৃত্রিম রাসায়নিক সার ব্যবহার করায় দিন দিন মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে ভূমিকা রাখছে কেঁচো সার। রাসায়নিক সার ব্যবহারে বিনষ্ট মাটির উর্বরতা শক্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম এই ভার্মি কম্পোস্ট।
কৃষি উদ্যোক্তারা জানান, পরিবেশবান্ধব কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন করতে অর্ধ পচা গোবর, শাকসবজির ফেলে দেওয়া অংশ অথবা পচা কলাগাছ একসঙ্গে মিশিয়ে সেখানে কেঁচো ছেড়ে দেয়া হয়। কেঁচো সেসব ময়লা খেয়ে মলত্যাগ করে ও বংশবিস্তার করে। কেঁচোর মলই মূলত জৈব সারে পরিণত হয়। জৈব সারে পরিণত হতে সময় লাগে এক থেকে দেড় মাস। তারা বিভিন্ন নার্সারি, কৃষক এবং দোকানদারের মাধ্যমে এই জৈব সার বিক্রয় করেন।
চাঁদপুর সদর উপজেলার তরপুরচণ্ডী ইউনিয়নে কাঠের পোল এলাকার শহীদুল্লাহ পাটোয়ারীর ছেলে তরুণ উদ্যোক্তা ফয়সাল পাটোয়ারী শুভ (৩২)। তিনি চাকরির পাশাপাশি একটু বাড়তি আয়ের আশায় কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদনের জন্য উদ্যোগ নেন। তার এ সার কোম্পানির নাম দেন পাওয়ারী জৈব সার কোম্পানি লিমিটেড। এ সার উৎপাদন করে মাত্র ৪ মাসের মধ্যে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। বর্তমানে ফয়সাল পাটোয়ারী শুভর উৎপাদন কেন্দ্র থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৭ থেকে ৮ টনের বেশি কেঁচো সার বাজারজাত করা হয়। এতে তিনি মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন।
সরেজমিন উদ্যোক্তা ফয়সাল পাটোয়ারী শুভর ভার্মি কম্পোস্ট প্রজেক্টে গিয়ে দেখা যায়, একটি বাড়ির সামনে পরিত্যক্ত জায়গাজুড়ে প্রায় ৩টি রিং, আটটি হাউস রয়েছে। যার ১৪ ফুট লম্বা, পাশে ১০ ফুট নিয়ে তৈরি করেছেন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন কেন্দ্র। এতে পুরোনো গোবর আর রেড বেঙ্গল কেঁচো দিয়ে রিং ও হাউসগুলো ঢেকে রেখেছেন। প্রতিটি হাউসে ১ লাখ এবং রিংয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার কেঁচো রয়েছে। কেঁচোগুলো হাউস এবং রিংয়ের গোবর খেয়ে মলত্যাগ করে। এই মল চা পাতার মতো হালকা আর ঝুরঝুর হয়ে হাউস এবং রিংয়ের ওপর দিকে উঠতে থাকে। প্রথম দেড় মাস পর প্রতি হাউসে দেড় টন এবং রিংগুলো থেকে ২৫-৩০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি হয়।
স্থানীয় কৃষক সোহেল খান বলেন, ‘শুভ আমাদের গ্রামের ছেলে। তার কাছ থেকে জৈব সার নিয়ে কলাবাগানে দিছিলাম; সঙ্গে লালশাক ক্ষেতেও দিছি। কলা ও শাকের বাম্পার ফলন হয়েছে। সেই সঙ্গে রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে যে খরচ হতো তার থেকে অনেক কম খরচ হয়েছে।’
এদিকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার বলাখাল গ্রামের আবুল কালামের ছেলে জাকির হোসেন ভুঁইয়া সোহাগ (৩১) নামে এক যুবক টারকি পালন ছেড়ে ২০১৯ সালে দশ কেজি কেঁচো ক্রয় করে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করেন। এখন তিনি ব্যাণিজিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছেন। ব্যাণিজিকভাবে বিক্রয়ের জন্য রেজিস্ট্রেশনের আবেদনও করেন তিনি।
হাজীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলরুবা খানম বলেন, ‘রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সারের ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজন। এর কারণ হচ্ছে, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করা। আমার উপজেলার জাকির ও শাকিল নামে দুই যুবক অগ্রগামী কৃষক। তারা এ ধরনের জৈব সার উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে। আমাদের মাধ্যমে তারা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছে। প্রশিক্ষণের পর তারা নিজেরাই বুঝতে পেরেছে এই সার ব্যবহারে ফলে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে তারা লাভবানও হচ্ছে।’
চাঁদপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তপন রায় বলেন, ‘ফয়সাল পাটোয়ারী একজন কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি চাঁদপুর সদর উপজেলায় ব্যাণিজিকভাবে কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী জানান, ‘জেলার বিভিন্ন স্থানে পরিবেশবান্ধব কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদনে ১৪ জন উদ্যোক্তা আছেন। তাদের উদ্বুদ্ধকরণের কারণে আরও নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে।’