জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার পর গত পাঁচ নভেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল ত্যাগের নির্দেশ দেয় প্রশাসন। ফলে বর্তমানে বন্ধ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা নেই। এর ফলে প্রতিবছরের মতো এবারও ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করেছে অতিথি পাখি। শিক্ষার্থী শূন্য ক্যাম্পাসে যেন তারাই রাজত্ব করছে। কোলাহল না থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বেশি পাখি এসেছে বলে মনে করছেন পাখি বিশেষজ্ঞরা।
নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত ও পাখির কলতানে মুখরিত জাবির মোহনীয় প্রকৃতির সবুজ ক্যাম্পাস। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভাঙে এখানকার সবার, বলা চলে শীতের সময়ে অতিথি পাখির সঙ্গে বসবাসের দুর্লভ সুযোগ মেলে ক্যাম্পাসবাসীর। রক্তকমল শাপলার মাঝে সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসা রকমারি প্রজাতির অতিথি পাখির বাহারি খেলায় মেতে ওঠা আকর্ষণীয় দৃশ্যে এখানের লেকগুলো জানান দিচ্ছে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক অনন্য প্রকৃতির গ্রাম বাংলার চিরচেনা সেই প্রাচীন রূপসী গ্রামীণ দুর্লভ এক মনোরম পরিবেশ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত সবুজ এই ক্যাম্পাসে হেমন্তের আমেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরাবরের মতোই কাঙ্ক্ষিত সেই অতিথি পাখির জলকেলিতে মুখর হয়ে ওঠতে শুরু করে জলাশয়গুলো। প্রতিদিনই দেখা মিলছে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজারো বাহারি অতিথি পাখি।
কনকনে শীতের সকালে সোনামাখা রোদে লেকগুলোতে হাজারো অতিথি পাখির কলকাকলি, সারাদিন খুনসুটি, সারা ক্যাম্পাসের আকাশে মুক্তডানায় ভর করে বাতাসে গা ভাসিয়ে দলবেঁধে হেলে-দুলে মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে।
ক্যাম্পাসের ছোট ও বড় আকারের জলজপদ্ম সুশোভিত জলাশয়ে বিভিন্ন প্রজাতির শত শত অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে। কুয়াশাচ্ছন্ন ও শীতের আবহাওয়ায় সবুজে সুশোভিত বিশাল এই এলাকা অতিথি পাখিদের কলরব পাখিপ্রেমী দর্শকদের মুগ্ধ করে তুলছে।
এ অতিথিদেরকে স্বাগত জানাতে নতুন রূপে সেজেছে জাবির জলাশয়গুলো। অসংখ্য রক্তিম ফুটন্ত লাল শাপলার সৌন্দর্যে মন মাতানো রূপ ধারণ করেছে জাবি ক্যাম্পাস। দূর থেকে তাকালেই প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। যে কারো নজর কাড়বে এ দৃশ্য। শহরের ব্যস্তময় যান্ত্রিক জীবন আর ইট পাথরে ঘেরা ধুলাবালি থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচতে ইতোমধ্যে অসংখ্য দর্শণার্থী ভিড় করছে ক্যাম্পাসে।
সাধারণত হিমালয়ের উত্তরের দেশ সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও নেপালে এ সময়টায় প্রচুর তুষারপাত হয়। এ তুষারপাতে পাখিরা মানিয়ে নিতে না পেরে বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে। শীতের শুরু আসে তারা আবার শীত চলে গেলে তারাও চলে যায় তাদের আপন ঠিকানায়।
জাবির এ আঙিনায় যেসব অতিথি পাখি আসছে তার মধ্যে অন্যতম- সরালী, পিচার্ড, গার্গেনি, মুরগ্যাধি, মানিকজোড়, কলাই, নাকতা, জলপিপি, ফ্লাইপেচার, কোম্বডাক, পাতারি, চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি ইত্যাদি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট-বড় প্রায় ১৪টি লেকের মধ্যে পরিবহন চত্বর, রেজিস্ট্রার ভবনের সামনের লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টারের লেকেও অতিথি পাখির সমাগম ঘটেছে। এ বছর এখন পর্যন্ত সুইমিংপুল সংলগ্ন লেক ও ট্রান্সপোর্ট সংলগ্ন লেক দুইটিতে দেশীয় সরালি নামের হাঁসজাতীয় পাখির দেখা মিলেছে বেশি। বাকি লেকগুলোতে এখনো পাখি আসতে শুরু করেনি।
ক্যাম্পাসে পাখি মেলার আহ্বায়ক, পাখি বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগরে যে পাখিগুলো আসে এগুলোর অধিকাংশই আমাদের দেশীয় হাঁসজাতীয় পাখি। অল্প কয়েক প্রজাতির বিদেশি পাখিও আসে। তবে তারা আসে ডিসেম্বরে। এখন যে পাখিগুলো এসেছে এগুলো সরালি। এরা সাধারণত বাংলাদেশের হিমালয়ের কাছাকাছি দূরত্বের জেলাগুলো ও হাওর-বাওরে বাস করে।
তিনি আরও বলেন, ‘এখন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় কোলাহল নেই। কোলাহলমুক্ত পরিবেশ পাখিদের অনেক পছন্দ। তাই এ বছর বেশি পাখি দেখা যাচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে পাখির সংখ্যা আবারও কমে যেতে পারে।’
জানা যায়, দুই ধরনের পাখির আগমন ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এক ধরনের পাখি ডাঙায় শুকনো স্থানে বা ডালে বসে বিশ্রাম নেয়। আরেক ধরনের পাখি বিশ্রাম নেয় পানিতে। এদের বেশিরভাগই হাঁসজাতীয়। এর মধ্যে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইফেচার, গার্গেনি, ছোট জিরিয়া, পান্তামুখী, পাতারি, মুরগ্যাধি, কোম্বডাক, পাতারী হাঁস, জলকুক্কুট, খয়রা ও কামপাখি অন্যতম। এছাড়া মানিকজোড়, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, নাকতা, খঞ্জনা, চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি, বামুনিয়া হাঁস, লাল গুড়গুটি, নর্দানপিনটেল ও কাস্তে চাড়া প্রভৃতি পাখিও হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসে এই ক্যাম্পাসে।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ