বাংলাদেশে খাঁচায় মাছ চাষ নূতন হলেও এশিয়ার কিছু দেশ যেমন চীন,তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম এবং নেপালে এর প্রচলন বেশ প্রাচীন। এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ প্রতিযোগিতা মূলকভাবে খাঁচায় মাছ চাষে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। খাঁচায় মাছ চাষে উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই খাদ্য বাবদ খরচ হয়।
খাঁচায় সূষম সম্পূরক খাদ্য প্রযোগের গুরুত্ব নিম্নরুপ:
মাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে
অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা যায়
মৃত্যু হার অনেকাংশে কমে যায়
অল্প সময়ে অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়
রোগাক্রান্ত হওয়ার আশংকা হ্রাস পায়
নির্ধারিত সময়ে কাংখিত আকারের মাছ উৎপাদন করা সম্ভব
খাঁচায় ব্যবহার উপযোগী সম্পূরক খাদ্য:-
সুষম সম্পূরক খাদ্যে সকল প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে এবং তা ব্যয় বহুলও বটে। এজন্য এ সব খাদ্যের অপচয় রোধে সতর্কতার সাথে খাদ্য প্রয়োগ করা প্রয়োজন। প্রবাহমান নদীতে খাঁচায় মাছ চাষের জন্য ভাসমান খাদ্য ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক। এতেএক দিকে মাছের চাহিদাঅনুযায়ী খাবার প্রদানকরা যায় এবংখাদ্যের অপচয় রোধকরা সম্ভব হয়।বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে মাছের খাদ্য বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি করার জন্য বহু খাদ্য কারখানা স্থাপিত হয়েছে।
এ সকল কারখানায় মাছের প্রজাতি ও বয়সের উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় মাত্রার পুষ্টি উপাদান বিশেষত: আমিষের মাত্রা নিশ্চিত করে,বিভিন্ন আকারের দানাদার ভাসমান খাদ্য তৈরি করা হচ্ছে। তন্মধ্যে মেগা ফিডস, আফতাব ফিড লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ, সিটি গ্রুপ, ইয়ন গ্রুপ ইত্যাদি কোম্পানীর খাদ্য উল্লেখ যোগ্য। চাষী বা খামার পর্যায়ে ভাসমান দানাদার খাদ্য তৈরি করা একদিকে যেমনঅত্যাধিক ব্যয় বহুল অন্য দিকে এর জন্য পৃথক শিল্প ব্যবস্থাপনার ও প্রয়োজন। এ কারণেই বাণিজ্যিক ভাবে অনেক সংখ্যক খাঁচায় তেলাপিয়া মাছ চাষের বেলায় নিজেদের তৈরি পিলেট খাদ্য ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়। বরং বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ভাসমান খাদ্য ব্যবহার করাই উত্তম।
খাঁচায়মাছ চাষের ক্ষেত্রে খাদ্যনির্বাচনে আরো একটিবিষয় গুরুত্বের সাথেবিবেচনা করতে হবে।তা হলো খাদ্যের দানারআকার। সচরাচর মাছের মুখের আকারের সাথেসামঞ্জস্য রেখে খাদ্যদানার আকার নির্বাচন করাহয়। আমরা যেওজনের তেলাপিয়া খাঁচায়মজুদ করি প্রাথমিকভাবে তাদেরজন্য ন্যূনতম ৩মিলিমিটার আকারের দানাদার খাদ্যপ্রদান করতে হবে।আর যখন তেলাপিয়ার ওজন৫০ গ্রাম হবেতখন তাদের জন্যখাবারের আকার বৃদ্ধিকরে ৫ মিলিমিটার আকারেরদানাদার ভাসমান খাবারপ্রদান করতে হবে।
খাদ্য প্রয়োগ মাত্রা ও কৌশল:
মাছের খাদ্য গ্রহণ মাত্রা নির্ভর করে পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলীর অনুকূল অবস্থার ওপর। তাপমাত্রা বাড়লে মাছের বিপাকীয় কার্যক্রমের হার বেড়ে যায়, ফলে খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধিপায়। একইভাবে পানির তাপমাত্রা কমে গেলে খাদ্য চাহিদাও কমে যায়। পানির পিএইচ মাত্রা ৭.০– ৮.৫ পর্যন্ত থাকলে ও পানিতে দ্রবিভূত অক্সিজেনের মাত্রা বাড়লে মাছের খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
বিপরীত ভাবে পিএইচ ও অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাবার কারণে খাদ্য গ্রহণ কমে যায়।এ ছাড়াও মাছ ছোট অবস্থায় তুলনামূলক বেশি খাবার গ্রহণ করে থাকে।খাঁচায় মাছ চাষে খাদ্য প্রয়োগ করতে হয় চাহিদার ভিত্তিতে। খাঁচায় ভাসমান খাদ্য ব্যবহার করাই শ্রেয়; কেননা খাদ্য প্রয়োগ করা হলে খাদ্যের কোন অংশ অব্যবহৃত থেকে গেল কিনা তা তাৎণিকভাবে পর্যবেণ করা সম্ভব। প্রতিটি খাঁচায় দিনের নির্ধারিত সময়ে অল্প অল্প করে খাদ্য সম্পূর্ন খাঁচায় ছিটিয়ে প্রদান করা হয়।
একবার প্রদানকৃত খাদ্য খাওয়া হয়ে গেলে আবার কিছু খাদ্য প্রদান করা হয়; এভাবে যখন দেখাযায় যে, খাদ্যগ্রহনের প্রবনতা অনেকটা কমে এসেছে অর্থাৎ খাদ্য গ্রহণ করছে তবে অনেকটা অলস ভাবে; এমন কিদু চারটি খাদ্যদানা ভাসমান থেকে যাচ্ছে তখন ঐ খাঁচায় খাদ্য প্রদান বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ মাছের চাহিদা মাত্রা পূরণের কাছাকাছি পর্যন্ত খাদ্য প্রদান করা হয়।এভাবে প্রতিটি খাঁচায় একের পর এক যথেষ্ট সময় পর্যবেণ করে খাদ্য প্রদান করতে হবে। মনোসেক্স তেলাপিয়াকে খাঁচায় মজুদের পর হতে বাজারজাত করার পূর্ব পর্যন্ত (৩০০-৩৫০গ্রাম ওজন/প্রতিটি) যেখাদ্য প্রদান করা হয় তাতে দৈহিক ওজনের বিবেচনায় খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা ৮%– ৩% এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে।
আর তেলাপিয়ার ওজন যখন ৫০০ গ্রাম অতিক্রম করে তখন তাদের দেহে অধিক পরিমান চর্বি জমা হয়, ফলে খাদ্য গ্রহনের প্রবনতা অনেক হ্রাস পায়। এরা তখন তাদের দেহ ওজনের ১% এর ওকম খাদ্য গ্রহন করে। তখন দিনে তাদেরকে একবার মাত্র খাদ্য প্রয়োগ করলেই চলে।
দৈনিক খাদ্য প্রয়োগ শিডিউল (feeding schedule):
বিভিন্ন বয়সের তেলাপিয়াকে দিনেবিভিন্ন শিডিউলে খাদ্যপ্রদান করতে হয়।সচরাচর যে বয়সেরবা আকারের মনোসেক্স তেলাপিয়া পোনামজুদ করা হয়(২৫ – ৩০ গ্রামওজনের) তাদের জন্যদিনে ৪ বারখাদ্য প্রদান করাপ্রয়োজন। আর তাদেরওজন ৫০ গ্রামঅতিক্রম করলে দৈনিক৩ বার খাদ্যপ্রদান করতে হবেএবং যখন তেলাপিয়া ১০০গ্রাম ওজন অতিক্রম করবে তখনতাদেরকে দৈনিক ২বার খাদ্য প্রদানকরতে হবে।
মাছের দৈহিক আকারেরভিত্তিতে খাঁচায় বর্ননাঅনুযায়ী যতবারই খাদ্যপ্রয়োগ করা হোকনা কেন, ল্যরাখতে হবে যেনএকবার খাদ্য প্রদানের পরছোট মাছের ক্ষেত্রে ৩ঘন্টা এবং বড়মাছের ক্ষেত্রে ৪ঘন্টা ব্যবধানের আগেদ্বিতীয়বার খাদ্য প্রদানকরা না হয়;অর্থাৎ প্রতিদুই বার খাদ্যপ্রদানের মাঝে ন্যূনতম ৩ঘন্টা (ছোট মাছেরক্ষেত্রে) এবং ৪ঘন্টা (বড় মাছেরক্ষেত্রে) ব্যবধান নিশ্চিত করেইতবে খাদ্য প্রয়োগকরতে হবে।
খাঁচায় খাদ্য প্রয়োগে বিবেচ্য বিষয়:
মেঘলা আবহাওয়ায় বা বৃষ্টির দিনে বা নিুচাপের সময় খাঁচায় খাদ্য প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে কিংবা কমিয়ে দিতে হবে। যে কোন কারণে খাঁচার মাছের ওপর পীড়ন (stress) সৃষ্টি হলে খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে এবং প্রয়োজনে বন্ধ রাখতে হবে। অন্যথায় খাদ্য অপচয় হয়ে পরিবেশ বিনষ্ট করবে।
যে সকল জলাশয়ে জোয়ার ভাটার প্রভাব সুস্পষ্ট সেখানে জোয়ার ভাটার অন্তর্বতীকালীন সময়ে যখন পানির উচ্চতা হ্রাস পায় এবং পানি একেবারে স্থির হয়ে যায় তখন খাদ্য প্রয়োগ না করে বরং যখন জোয়ার বা ভাটার মৃদু স্রোত থাকে তখন খাদ্য প্রদান করাই উত্তম।
তথ্যসূত্রঃ আধুনিক কৃষি খামার
ফার্মসএন্ডফার্মার/১২অক্টোবর২০