জৈব সার কি?
জীব দেহ হতে প্রাপ্ত বা জীবদেহের ধ্বংশাবশেষ হতে প্রাপ্ত/প্রস্তুত সারই জৈব সার। যেমনঃ গোবর সার, খামারজাত সার, কম্পোস্ট, আবর্জনা সার, খৈল, সবুজ সার, ছাই, হাড়ের গুড়া প্রভৃতি জৈব সার।
জৈব সারের শর্তাবলী
১। জৈব সারে কমপক্ষে ২০% জৈব পদার্থ থাকতে হবে।
২। জৈব সারে ১০-১৫% আর্দ্রতা থাকতে হবে।
৩। জৈব সারে নিকেল, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক ইত্যাদি সহনশীল মাত্রার অতিরিক্ত থাকা যাবে না।
জৈব সারের উপকারিতা
১। একাধিক উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদানের উত্তম উৎস- নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান। ফলে মাইক্রো ও মেক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাব পূরণ হয়।
২। পুষ্টি উপাদান জমিতে অনেক দিন থাকে । জমিতে সার ব্যবহারের পর ধীরে ধীরে গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী অনেকদিন ধরে তা গ্রহন করতে পারে। জমিতে প্রয়োগের পর আনুমানিক ৬-১৮ মাসব্যাপী এর প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু রাসায়নিক সারের পুষ্টি উপাদান দ্রুত কিছুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।
৩। রাসায়নিক সারের কার্যকরিতা বাড়ায় ও গাছ কর্তৃক রাসায়নিক সারের গ্রহনক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৪। মাটির উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধিঃ এর ফলে মাটি নরম হয়।গাছ সহজতর উপায়ে মাটি হতে খাদ্য উপাদান গ্রহন করে।
৫। মৃত্তিকা গঠন ও সংযুক্তি উন্নয়ন হয়ঃ মাটির গঠন ও গুনাগুন উন্নত করে বলে মাটি সরস হয়, এঁটেল মাটিকে কিছুটা দোঁ-আশ ভাবাপন্ন করে ফসল জন্মানোর উপযোগী করে তোলে।
৬। মাটিস্থ বিষাক্ততা দূর করেঃ বালাইনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের আধিক্যের সৃষ্ট বিষাক্ততা জৈব সার কর্তৃক দূরীভূত হয় ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
৭। পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে ফলে সেচের পানির অপচয় কমায়।
৮। বায়ু চলাচল ক্ষমতা বৃদ্ধি করে মাটি নরম আলগা ঝুরঝুরে হয়।এ ছাড়া জৈব পদার্থের উপস্থিতির জন্য কেঁচো, পিঁপড়া, উঁইপোকা গর্তের সৃষ্টি করে ফলে বায়ু চলাচল ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গাছের শিকড় বেশী পরিমাণে অক্সিজেন পায়। ফলে গাছ সতেজ হয়ে উঠে।
জৈব পদার্থ/জৈব সার হতে প্রাপ্ত বিবিধ উদ্ভিদ পুষ্টির তালিকা
জৈব পদার্থ ১ টন জৈব পদার্থ হতে প্রাপ্ত উদ্ভিদ পুষ্টির পরিামণ (কেজি) জৈব পদার্থ ১ টন জৈব পদার্থ হতে প্রাপ্ত উদ্ভিদ পুষ্টির পরিামণ (কেজি)
N P K N P K
গোবর (পচানো) ৪.৫ ১.৫ ৫.০ সরিষার খৈল ২৫.৫ ৪.০ ৫.০
খামারজাত সার ৩.০ ০.৭ ২.৫ হাড়ের গুড়া ১৯.৫ ৫২.৫ —
হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা ১১.৫ ১০.৫ ৭.০ ধৈঞ্চা ২.৫ ০.৩ ২.০
কম্পোস্ট (গ্রামীন) ২.৫ ১.০ ৩.০ ধানের খড় ২.০ ০.৫ ৫.৫
খামারজাত সার:
যে সার গরু,মহিষ, ভেড়া, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি গৃহপালিত জীব জন্তুর মলমূত্র মিশ্রিত খড়/কুঁটো সহযোগে খামার প্রাঙ্গণের একপাশে জমা করা হয় বা তৈরি করা হয় সেটিই খামারজাত সার। খামারজাত সারের তিনটি প্রধান অংশ হচ্ছে পশুর মল, পশুর মূত্র ও গোয়ালঘরে ব্যবহৃত খড় বা নাড়া এসব বিছানা। খামারজাত সারে মলের চেয়ে মূত্র ভাগে অধিকতর খাদ্য উপাদান বিশেষ করে নাইট্রোজেন ও পটাশিয়াম থাকে। তাই খামারজাত সারে মূত্রের বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়। গোয়াল ঘরের মেঝে হতে মূত্র সহজেই গড়িয়ে অন্যত্র বা নিচের দিকে চলে গিয়ে নষ্ট হয়। তাই মেঝেতে খড়/নাড়া/তুষ বা কাঠের গুঁড়োর বিছানা পেতে দিলে তাতে মূত্র শোষিত হয়ে থেকে যায়।গোয়াল ঘরে প্রত্যহ বিকেলে বিছানা ভালো করে বিছিয়ে দিতে হবে যেন, মূত্র সবটুকুই শুষে নিতে পারে। সকালে সকল মূত্র ও লিটার সংগ্রহ করতে হবে। এ বিছানা মলের অংশে মিশিয়ে পচালে উন্নতমানের খামারজাত সার প্রস্তুত হয়। প্রতিদিন পশু প্রতি ১/২-৩ কেজি পর্যন্ত মূত্র পাওয়া যায়। সম্ভব হলে গরু বাছুর যে দিকে দাঁড়িয়ে খড়/কুঁটো খায় তার পেছনের দিকে নালা করে সে বরাবর একটি পাকা গর্তে মূত্র করার ব্যবস্থা করলে মূত্রের অপচয় রোধ করা যায়। জমাকৃত মূত্র একটি পুরোনো ভান্ডের সাহায্যে উঠিয়ে গোবরের গাদায় বা সরাসরি জমিতে ব্যবহার করা যায়।
আবার পশু মাঠে চরে বেড়ানো বা কাজ করার সময় গবাদিপশুর পিছে বিশেষ ধরনের থলে বেধে দিতে হবে। থলেতে মল-মূত্র সংগৃহীত হবে। বিভিন্ন পশু থেকে কতটুকু মল-মূত্র সংগ্রহ হতে পারে, তা পশু ও পশুখাদ্যের উপর নির্ভর করে।
খামারজাত সারের পরিমান ও গুণাগুণ নির্ভর করে জীব জন্তুর শ্রেণী, তাদের বয়স, খাদ্যের বিভিন্নতা,গোয়াল ঘরের বিছানায় ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, গাদায় সংরক্ষণ ব্যবস্থা এসবের ওপর। এ সার ভালোভাবে পচলে জমিতে ব্যবহার উপযোগী হয়।
সংরক্ষন পদ্ধতিঃ
১. গো–শালার কাছে গর্ত করে খামারজাত সার সংরক্ষণ করতে হবে। আনুমানিক ১.৫ মিঃ দৈর্ঘ্য, ১.৫ মিঃ প্রস্থ ও ১ মিঃ গভীর আকারের ২ বা অধিক গর্ত করতে হবে। গর্তের সংখ্যা ও আকার খামারজাত সার এর উপকরণ প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করবে।
২. গোবরে সূর্য্যালোক সরাসরি পড়লে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাথে সাথে নাইট্রোজেন এর অপচয় হয় ও গোবর শুকিয়ে যায়৷ আবার, বৃষ্টি পড়লে নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য খাদ্যোপাদান ও প্রচুর জৈবপদার্থের অপচয় হয়৷ এভাবে মোট উপাদানসমূহের প্রায় ৫০%ই অপচয় হতে পারে৷ তাই মাটিতে গর্ত করে গর্তের তলা ও চারপাশ ইট দিয়ে পাঁকা করে উপরে চালার ব্যবস্থা করে দিলে ভালো।
৩. প্রথমে গোবর ও অন্যান্য জৈব পদার্থ দ্বারা ১টি গর্ত সম্পূর্ণ পূর্ণ করতে হবে। একটি পূর্ণ হওয়ার পর উপরে কাদা ও গোবরের প্রলেপ দিয়ে রাখতে হবে। পরে অন্য গর্ত একইভাবে পূরণ করতে হবে।
৪. কোন কারণে খামারজাত সার শুষ্ক হলে পানি ছিটাতে হবে।
৫. পচনের জন্য ৬-৮ সপ্তাহ সময় লাগে। টেকসই উচ্চ ফলনের জন্য কোন ফসলে জমি তৈরীর সময় পচনকৃত খামারজাত ও সার প্রয়োগ করতে হবে।
সুষমায়ন পদ্ধতি (সমানভাবে মিশানো)
১। খামারজাত সারে নাইট্রোজেন ও পটাসিয়ামের এর তুলনায় ফসফরাস কম থাকে৷ তাই, পচনের সময়ে ফসফরাস সরবরাহ করে সুষমায়ন করা আবশ্যক।
২। সুষমায়নে ৭.২৫ কেজি টিএসপি প্রতি টন খামারজাত সারের সাথে স্তরে স্তরে ছিটিয়ে পচিয়ে নিতে হবে৷ পচন তাজা অবস্থায় গোবর/খামারজাত সার/জৈবপদার্থ জমিতে প্রয়োগ করা ক্ষতিকর৷ যেকোনো জৈবপদার্থ প্রয়োগের পূর্বে পচিয়ে নিতে হয়।
৩। খামারজাত সারের পচনে সাধারণত ৩-৪ মাস সময় লাগে৷ গর্তে বেশি প্রবেশ করলে পচনে বিলম্ব হয়৷ আবার, খুব শুকিয়ে গেলেও পচনে বিঘ্ন হবে৷ গর্ত ভর্তি হওয়ার পর মাটি ও গোবর মিশিয়ে যে আস্তর দেয়া হয়, তাতে আদ্র্তা সংরক্ষিত হয় এবং অক্সিজেন এর অভাবে পচনকারী ব্যাকটেরিয়া বেশি কাজ করে৷ এতে নাইট্রোজেন এর অপচয় কম হয়।
মেহেদী হাসান খান
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা
রূপসা, খুলনা
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৫অক্টোবর২০