খামারীদের উৎপাদন খরচ কম করে ছাগলের জন্য মানসম্মত ফিড তৈরি করবেন যেভাবে

2529

প্রাণী ভেদে খাদ্যের প্রোটিন, ক্যালরি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের ভিন্নতা হয়ে থাকে। ইতোপূর্বে আমার করা নিম্নোক্ত ফিড ফর্মুলেশন গুলোতে বয়স ভেদে-
(ক) টার্কির ফিড ফর্মুলেশনে সর্বোচ্চ ২৮% ক্রুড প্রোটিন
(খ) দেশী, সোনালী এবং লেয়ারের জন্য সর্বোচ্চ ২০% ক্রুড প্রোটিন
(গ) কোয়েল এর জন্য সর্বোচ্চ ২৭% ক্রুড প্রোটিন
(ঘ) হাঁসের জন্য সর্বোচ্চ ২২% ক্রুড প্রোটিন
মান সম্বলিত তালিকা খামারীদের উৎপাদন খরচ কমানোর স্বার্থে প্রকাশ করেছি। মূলত যে প্রাণী খাদ্যে প্রোটিন মান যত বেশী দরকার হয়, তা তৈরি করতে খরচও তত বেশী হয়। কেননা প্রোটিনের মূল উৎস হিসাবে ব্যবহৃত উপাদান গুলো যেমনঃ সয়াবিন মিল, ফিসমিল, বিভিন্ন ধরনের খৈল, বিভিন্ন ধরনের ডাল, প্যাকেটজাত প্রোটিন ইত্যাদির দাম অন্যান্য উপাদানের তুলনায় অত্যন্ত বেশী।
Nutrient Requirements of Goats in Temperate and Tropical Countries. 1981. National Research Council
এবং
Pinkerton, F. 1989. Feeding Programs for Angora Goats. Bulletin 605. Langston University এর তথ্য অনুযায়ী মাংস উৎপাদনে ব্যবহৃত ছাগলের জন্য বয়সভেদে সর্বনিম্ন ১০% এবং সর্বোচ্চ ১৪% ক্রুড প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার প্রয়োজন হয়।
যেহেতু ছাগলের খাবারে প্রোটিন মান পোল্ট্রির তুলনায় অত্যন্ত কম প্রয়োজন হয়, সেহেতু হাঁস-মুরগির ফিডের তুলনায় প্রায় অর্ধেক খরচে ছাগলের জন্য মানসম্মত ফিড তৈরি করা সম্ভব।
Mdukatshani, Heifer International-South Africa
এবং
KwaZulu-Natal Department of Agriculture and Rural Development হতে প্রকাশিত “Goat Production Handbook” এ ছাগলের জন্য বয়স ও শারীরিক অবস্থা ভেদে সর্বনিম্ন ১০% এবং সর্বোচ্চ ১৪% ক্রুড প্রোটিন সমৃদ্ধ ০৪(চার) রকমের খাবার পরিবেশনের কথা বলা হয়েছে।
বয়স ও শারীরিক অবস্থা ভেদে পুষ্টিমান কাছাকাছি প্রয়োজন হওয়ায় এবং বয়স ভেদে খামারীদের চার রকমের ফিড তৈরির ঝামেলা এড়ানোর লক্ষ্যে আমাদের দেশে সহজলভ্য সব উপাদান এবং কিছু ভেষজ ব্যবহার করে ছাগলের জন্য প্রস্তুত করা আমার নিজস্ব ফিড ফর্মুলেশনটি যা বিগত দুই বছরেরও বেশী সময় আমার নিজ খামারে ব্যবহারের পর সকল খামারীদের উৎপাদন খরচ কমানোর স্বার্থে প্রকাশ করা হল। যেহেতু আমি কোন পুষ্টিবিদ কিংবা ভেট নই এবং পুরো ক্যালকুলেশনই আমার নিজ হাতে করা, কোন ধরনের ল্যাব টেস্ট করা হয়নি সেহেতু ফর্মুলেশনটি ব্যবহার করা বা না করা আপনার ঐচ্ছিক।
দুগ্ধবতী ছাগী এবং এক বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য (ক্রুড প্রোটিন ১৪%+ , ক্যালরি ২১০০+)
উপাদান পরিমাণ
——– ——–
১। গম ভাংগা/ চালের খুদ ১৮কেজি।
২। ভূট্টা ভাংগা ৪২কেজি।
৩। সরিষার খৈল/মটর ডাল (এ্যাংকর)/ধইঞ্চা বীজ ০৮কেজি।
৪। রাইস ব্রান ২২.৩৫০কেজি।
৫। সয়াবিন মিল ০৭কেজি।
৬। ডি.সি.পি ০১কেজি।
৭। আয়োডিন লবন ০১কেজি।
৮। ভিটামিন প্রিমিক্স ২৫০ গ্রাম।
৯। বেকিং সোডা (খাবার সোডা) ১০০গ্রাম।
১০। মেথি ১০০গ্রাম।
১১। কালোজিরা ১০০গ্রাম।
১২। আজওয়াইন (জোয়ান, জৈন নামে পরিচিত) ১০০গ্রাম।
মোট=১০০কেজি।
এক বছরের বেশী বয়সী ছাগী, খাসি, পাঠা এবং গর্ভবতী ছাগীর জন্য (ক্রুড প্রোটিন ১২%+, ক্যালরি ২০০০+)
উপাদান পরিমাণ
——– ——–
১। গম ভাংগা/ চালের খুদ ২০কেজি।
২। ভূট্টা ভাংগা ৪৭কেজি।
৩। সরিষার খৈল/মটর ডাল (এ্যাংকর)/ধইঞ্চা বীজ ১০কেজি।
৪। রাইস ব্রান ২০.৩৫০কেজি।
৫। ডি.সি.পি ০১কেজি।
৬। আয়োডিন লবন ০১কেজি।
৭। ভিটামিন প্রিমিক্স ২৫০ গ্রাম।
৮। বেকিং সোডা (খাবার সোডা) ১০০গ্রাম।
৯। মেথি ১০০গ্রাম।
১০। কালোজিরা ১০০গ্রাম।
১১। আজওয়াইন (জোয়ান, জৈন নামে পরিচিত) ১০০গ্রাম।
মোট=১০০কেজি।
অতিরিক্ত আরো কিছু উপাদান যা লাগবে-
১। চিটা গুড় (রাব, নালী গুড় নামে পরিচিত)
২। বেকারী ঈস্ট (সুপার শপ অথবা বড় মুদি দোকানে পাবেন)
প্রতিদিন কি পরিমাণ দানাদার দিবেন-
বিএলআরআই এর তথ্য অনুযায়ী প্রাপ্ত বয়ষ্ক ব্লাক বেংগল ছাগলের জন্য মাথাপিছু ১৬০ গ্রাম দানাদার প্রয়োজন হয়। ক্রস ছোট আকারের ছাগলের জন্যও এটা অনুসরণ করা যেতে পারে। সাধারণত বড় জাতের ছাগলের জন্য দৈনিক ২০০-৪০০গ্রাম দানাদার খাবার দিতে হয়। এছাড়াও ছাগলের জাত, দুধ উৎপাদন, ঘাসের প্রোটিনমান, দৈহিক ওজন ইত্যাদি আরো কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে ক্ষেত্র বিশেষে পরিমাণে কিছু কম বা বেশী দিতে হয়।
প্রস্তুত প্রণালীঃ-
ধাপ-১:
প্রথমেই খাদ্য উপাদান গুলোকে ০৩(তিন)টি ক্যাটাগরীতে ভাগ করে নিন। ক্রমিক নং০১ এবং ০২ একটা ক্যাটাগরী (সরিষার খৈল ব্যবহার না করলে ০১-০৩ পর্যন্ত একই ক্যাটাগরীতে থাকবে)। সরিষার খৈল ব্যবহার করলে তা আলাদা ক্যাটাগরীতে রাখুন। বাকি সব উপাদানগুলো আরেকটা ক্যাটাগরীতে।
ধাপ-২:
এবার সরিষার খৈল বাদে ক্যাটাগরী অনুযায়ী বাকি উপাদান গুলো আলাদা মিশিয়ে নিয়ে আলাদা বস্তায় অথবা ড্রামে সংরক্ষণ করুন।
ধাপ-৩:
এবার আপনার খামারে ছাগলের সংখ্যা হিসাব করে মোট কত কেজি দানাদার খাবার লাগবে তা ক্যাটাগরী অনুযায়ী আলাদা আলাদা পরিমাপ করে নিন।
ধাপ-৪:
প্রতিদিন সন্ধায় পরিমাণ মত পানি কুসুম গরম করে তার মধ্যে ১-২ মুঠি চিটাগুড় এবং প্রথম ক্যাটাগরীর খাদ্য উপাদান অর্থাৎ গম ও ভূট্টা প্রতি কেজির জন্য ০৩-০৪ গ্রাম বেকারী ঈস্ট ভাল করে মিশিয়ে নিন।
ধাপ-৫:
এবার সেই পানিতে প্রথম ক্যাটাগরীর খাদ্য উপাদান অর্থাৎ ভুট্টা এবং গম মাখা মাখা করে মিশিয়ে নিয়ে ঢাকনাযুক্ত কোন ড্রাম অথবা বালতিতে বায়ুরোধ করে রেখে দিন।
ধাপ-৬:
আলাদা একটা পাত্রে সরিষার খৈল ভিজিয়ে রাখুন (যদি সরিষার খৈল ব্যবহার করেন সেক্ষেত্রে)।
ধাপ-৭:
পরদিন ০৩(তিন) ক্যাটাগরীর উপাদানই একসাথে মিশিয়ে ছাগলকে পরিবেশণ করুন। সাথে কিছু পরিমাণ হে অথবা ধানের খর টুকরো করে কেটে মিশিয়ে দিতে পারেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ-
(ক) ছাগলকে যেকোন নতুন খাবারই অল্প অল্প করে খাইয়ে অভ্যাস করিয়ে নিতে হবে।
(খ) গম, ভূট্টা ইত্যাদি অবশ্যই ভেংগে নিতে হবে। দানাযুক্ত খাবার ভেংগে না দিলে ছাগলের হজম প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে।
(গ) আপনি চাইলে ঈস্ট ব্যবহারের পরিবর্তে গম ও ভুট্টা সিদ্ধ করেও ব্যবহার করতে পারেন।
নির্ঘন্টঃ-
একটা ছাগলের খামারে মোট উৎপাদন ব্যয়ের শতকরা ৬৫-৭৫ ভাগ খরচ নির্ভর করে খাদ্য খরচের উপর। এখানে ব্যয়ের লাগাম না টেনে ধরতে পারলে খামারীর লাভের গুড় পিপড়ায় খাবে। বেশ কিছুদিন পূর্বে আমি একটা পোস্টে ব্লাক বেংগল ছাগলের দৈনিক খরচ ১০টাকারও কমে আনা সম্ভব সেটা দেখিয়েছিলাম। যেটার কারনে অনেক খামারী ভাই এখনো পর্যন্ত আমাকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং বাজে মন্তব্য করে থাকেন।
হ্যা, আমি আজকেও বলছি প্রতিটি ছাগলের পেছনে দানাদার খাবার বাবদ দৈনিক ১০টাকা অর্থাৎ মাসে ৩০০টাকার বেশী খরচ হলে মাংসের দামে ছাগল বেঁচলে পেট চালাতে কষ্টকর হবে। খরচ কমানোর প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে- পর্যাপ্ত ঘাস, হে অথবা সাইলেজের যোগান।
1. বছরের কোন কোন সময় দানাদার খাবার বানাতে আমার প্রতি কেজি ২৫টাকারও কম পরে। তবে গড়ে সারা বছর ২৫-২৮টাকার মধ্যেই থাকে।
2. কিছু উপাদান যেমনঃ- গম, ভূট্টা, ধইঞ্চা বীজ ইত্যাদি নিজেরা উৎপাদন করতে পারলে দানাদার খরচ আরো কমানো সম্ভব।
3. ছাগলকে চাড়ন ভূমিতে চড়াতে পারলে কিংবা অন্তত পক্ষে বছরের কয়েক মাসও যদি চড়ানো যায় তাহলে গড় উৎপাদন খরচ অনেকাংশেই কমানো সম্ভব।
4. ভালোমানের হে, লিগিউম অথবা কর্ন সাইলেজ খাওয়াতে পারলে দানাদার কমিয়ে দেওয়া যায় অথবা গর্ভকালীন সময়ের ২য় এবং ৩য় মাস চলা ছাগী এবং একবছরের বেশী বয়সী ছাগী-খাসির জন্য না দিলেও বিশেষ সমস্যা নাই। এর ফলেও গড় উৎপাদন খরচ কমবে।
5. ভলিউম যত বাড়বে অর্থাৎ ছাগলের সংখ্যা যত বাড়বে গড় উৎপাদন খরচ ততই কমবে।
6. সর্বোপরি অনুকূল পরিবেশ এবং ব্যবস্থাপনা জ্ঞান ভালো থাকলে মোট উৎপাদন খরচ অনেক কমানো সম্ভব।
পুনশ্চঃ-
ছাগলের দানাদার খাবার বলতেই যারা বিভিন্ন রকমের ভূষি বুঝেন, যারা চিলে কোঠায় ছাগল পালেন, যাদের দলাদলি ও গ্রুপিং করার চুলকানি রোগ আছে এবং সর্বোপরি যারা তর্ক করতে চান তাদের সাথে আমার মত কখনোই মিলবেনা এটাই চিরন্তন সত্য। সুতরাং পোস্টটি তারা এড়িয়ে চলুন। আর যারা প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান পিপাসু, ব্যবস্থাপনা বুঝেন, বানিজ্যিকতা বুঝেন এবং বিজ্ঞানমনা তারা আরোও বিস্তারিত জানতে এবং আমার ফার্মের রেজাল্ট দেখতে স্বশরীরে আসতে পরেন আমাদের শখের খামার এগ্রো প্রজেক্টে।
পরিশেষেঃ-
ব্যবসায়ে লাভ দুই ভাবেই করা যায়- আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে এবং ব্যয় সংকোচন করে। আমার মতে ফার্মিং এ ব্যয় সংকোচন করলে আয় এমনিতেই বৃদ্ধি পায়। সুতরাং মেধা ও মনন দিয়ে সেটাই চেষ্টা করুন। সৌখিন ছাগল নিয়ে হুজুগ ছড়িয়ে, ভুলভাল বুঝিয়ে, নিন্দাবাদে জড়িয়ে, গেম খেলে লাখ টাকা কামানোকে সফলতা নয় প্রতারণা বলে।

-চাষী মানিক
পরিচালক শখের খামার এগ্রো প্রজেক্ট
ও ফাউন্ডার
Livestock (প্রাণিসম্পদ) Master’s Community School

ফার্মসএন্ডফার্মার/৩০এপ্রিল২০