খেজুরের গুড় বিক্রি করে রাজশাহীতে ১৫০ কোটি টাকার আয়ের সম্ভবনা

145

কমছে তাপমাত্রা, উঁকি দিচ্ছে শীত। এরই মধ্যে উত্তরের জেলা রাজশাহীতে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে গাছিদের। প্রতিদিন ভোরে তারা বেরিয়ে পড়ছেন রস সংগ্রহে। দেশে যুগ যুগ ধরে বাঙালির রসনায় খেজুর গুড়ের প্রাধান্য পেয়ে আসছে। তাই তো শীতের মৌসুমে নানান রকমের পিঠা-পুলি তৈরিতে রাজশাহীর খেজুর গুড়ের জুড়ি নেই। প্রতি বছরের মতো এ বছরও তীব্র শীত উপেক্ষা করে রাজশাহীর হাটগুলোয় জমে উঠেছে জমজমাট খেজুর গুড়ের ব্যবসা। রাজশাহীতে এবছর বেড়েছে খেজুরের গুড় কেনাবেচা। সেই সঙ্গে বাড়ছে রস থেকে গুড় উৎপাদনও। রস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন রাজশাহীর চার উপজেলার অন্তত ৫০ গ্রামের মানুষ। এতে চাঙা গ্রামীণ অর্থনীতি। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, অসাবধানতায় এ রসেই ঘটতে পারে জীবনের ইতি।

রাজশাহী কৃষি বিভাগ বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি বিভাগ জেলায় গুড় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে আট হাজার ৮৯১ মেট্রিক টন। এবছর ১৪৬ কোটি ৬৯ লাখ ৫২ হাজার ১০০ টাকা আয় হতে পারে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

২০২২-২৩ মৌসুমের হিসেবে রাজশাহী জেলায় মোট খেজুরের গাছ রয়েছে ১১ লাখ আট হাজার ১৮টি। আবাদ হয়েছে ৫৪১ দশমিক ৩৭ হেক্টর জমিতে। এছাড়া মোট গুড়ের উৎপাদন ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার ১৪৬ কেজি বা আট হাজার ৮৬৪ মেট্রিক টন। আর বিক্রি হবে ১৪১ কোটি ২০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

আর ২০২১-২২ মৌসুমের হিসেবে রাজশাহী জেলায় মোট খেজুরের গাছ ছিল ১১ লাখ ৩২৩টি। আবাদ হয়েছে ৫৩৮ দশমিক ৩৭ হেক্টর জমিতে। এছাড়া মোট গুড় উৎপাদন হয়েছে ৮৮ লাখ দুই হাজার ৫৮৬ কেজি বা আট হাজার ৮০২ মেট্রিক টন। আর বিক্রি হয়েছে ৮৮ কোটি দুই লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শীতকালে খেজুর রস ও গুড়ের জন্য জেলার পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাঘা ও চারঘাট উপজেলা এরই মধ্যে সুখ্যাতি পেয়েছে। রাজশাহীর প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের সংসার চলছে খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে। প্রায় ৫৪৩ হেক্টর জায়গাজুড়ে রয়েছে খেজুরগাছ। জেলায় বর্তমানে খেজুরগাছের সংখ্যা ১১ লাখ ১১ হাজার ৩৪৩টি। রস ও গুড় থেকে গত মৌমুমে ১৪১ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা আয় করেন এখানকার গাছিরা। জেলায় সবেচেয়ে বেশি খেজুর গুড় উৎপাদিত হয় বাঘা উপজেলায়।

এদিকে বাঘা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, মৌসুমে খেজুর গুড় থেকে সরকারিভাবে ৩০ কোটি টাকা আয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উপজেলায় দুটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নে ৩০ হাজার ৩৮৯ জন কৃষি পরিবার রয়েছে। খেজুর বাগান রয়েছে চার হাজার। এছাড়া সড়কপথ, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনা মিলে দেড় লক্ষাধিক খেজুরগাছ আছে। একজন গাছি প্রতিদিন ৫০-৫৫টি খেজুরগাছের রস আহরণ করতে পারেন। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চার হাজার গাছি রস সংগ্রহ করেন।

প্রতি মৌসুমে তারা খেজুরগাছের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে উদ্যোক্তা পেলে আমের মতো গুড় রপ্তানিতেও সরকার সহায়তার চিন্তা-ভাবনা করছে। এর জন্য ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা খোঁজা হচ্ছে। একজন কৃষক তাদের গাছের সংখ্যা অনুপাতে গাছি নিয়োগ করেন। তারা মৌসুমজুড়ে রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত থাকেন। উপজেলার আমের যেমন দেশ ও বিদেশে খ্যাতি রয়েছে, তেমনি খেজুর গুড়ের খ্যাতিও রয়েছে।

উপজেলায় গুড়ের প্রধান হাট বাঘা ও আড়ানী হাট। এরপর রয়েছে মনিগ্রামসহ অন্যান্য হাট। সপ্তাহে রোববার ও বৃহস্পতিবার বাঘারহাট বসে। এ হাটেই সবচেয়ে বেশি গুড় বেচাকেনা হয়। উপজেলার বাঘা ও আড়ানী পৌরসভা ছাড়াও বাজুবাঘা, গড়গড়ি, পাকুড়িয়া, মনিগ্রাম, আড়ানী, বাউসা ও চকরাজাপুর ইউনিয়নের অন্যান্য হাটেও যথেষ্ট পরিমাণ গুড় বেচাকেনা হয়। তবে বেশি দাম পাওয়ার আশায় অনেকেই বাঘারহাটে গুড় বিক্রি করতে আসেন। বাঘার হাটে রোববার প্রতি কেজি খেজুর গুড় ১১০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়। মৌসুমের একেবারে শুরুতে এ গুড়ের দাম প্রতি কেজি ১৪০-১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। প্রতি বছরই মৌসুমের শুরুতে বেশি দামে গুড় বিক্রি হলেও ভরা মৌসুমে দাম কিছুটা কমে যায়।

বাঘা বাজারের ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার এনামুল হক বলেন, চলতি শীত মৌসুমে প্রায় ৪০-৪৫ কোটি টাকার গুড় বেচা কেনা হবে। ফলে উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টাকা আয় করবেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সরকারি হিসেবে চলতি মৌসুমে মানুষ খেজুর গুড় থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা আয় করবেন। উপজেলায় ৩৫ হেক্টর জমিতে খেজুরগাছ রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাণিজ্যিকভাবে খেজুর গুড় উৎপাদনে সহায়তা দেয়া হলে এই গুড়কে আরও লাভজনক করা সম্ভব। আমের মতো খেজুর গুড় বিদেশে রপ্তানি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিদেশে রপ্তানি করা হলে এই গুড় থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবেন।’

গাছিরা বলছেন, রস ও গুড়ের উপার্জন দিয়ে বছরের ছয় মাস তাদের সংসারের যাবতীয় খরচ মেটে। বাড়তি টাকা থেকে অন্য মৌসুমি ফসলও উৎপাদন করছেন তারা। রসে অতিরিক্ত জাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়।

৪০ বছর ধরে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি করে বিক্রি করছেন পুঠিয়া উপজেলার বাসিন্দা আফসার মোল্লা। দেখা যায়, আফসার মোল্লার স্ত্রী টিনের বস্তুতে রস জাল দিচ্ছেন। পাশে নির্দেশনা দিচ্ছেন স্বামী। প্রতিদিন ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এটা তাদের রুটিন ডিউটি।

কথা হয় আফসার মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি ১২০-১৩০টা গাছ কাটি। পয়সাডা পাওয়া যায় ভালো, নতুন নতুন পয়সা প্রতি হাটে আসে। অন্য মৌসুমে কিছু ফসল পানি করি, এতে চলে যায় আমার। রস দিয়ে গুড় করি। সংসার ভালোমতো চলে। এটা দিয়ে কিস্তি দিতে পারি।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিবছর শীতকালে গ্রামীণ জনপদে তৈরি হয় রস উৎসব। পরিবার-পরিজন নিয়ে রস পান করে থাকেন তারা। রসে তৈরি পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করেন স্বজনদের। এছাড়া খেজুর গুড়ের বাহারি রকমের পিঠা-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে এ অঞ্চলে। এ রস দিয়ে অনেক পিঠা-পুলি তৈরি করা হয়। এ শীতের সময় একটা উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। এ উৎসবে আমরা পিঠা-পুলি তৈরি করে জামাইকে খাওয়ানো হয়।

আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বাদুড় থেকে এ ভাইরাস ছড়ায়। শীতকালে দেশে উৎসব করে খেজুর রস পান করা হয়, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। খেজুর রসের প্রকৃত স্বাদ না পেলেও মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রার ওপরে রস ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ আইইডিসিআরের। শীতে খেজুর রস পানে সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে রাজশাহীর ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মতিন বলেন, সাধারণত খেজুরের কাঁচা রস বা আংশিক খাওয়া ফল, গাছের যেটা বাদুড় খেয়ে ফেলে, এ ধরনের খাদ্য থেকে ভাইরাসটা ছড়ায়। প্রতিরোধের জন্য আমরা আগে থেকেই বলি, শীত মৌসুমে আপনারা কাঁচা খেজুরের রস খাবেন না।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, পরিষ্কার ও নিরাপদ খেজুরের রস শরীরের জন্য পুষ্টি সঞ্চয় করে থাকে। এই রস থেকে তৈরি করা গুড় শীতের পিঠা ও পায়েসের মূল উপকরণ। এদেশের কৃষকরা গাছ থেকে ফল উৎপাদন করছে, কিন্তু পরিমাণ মতো গাছের পরিচর্যা করছে না। এখানে রাস্তার ও বাড়ির পাশে অনেক খেজুরগাছ রয়েছে। সেগুলো থেকে রস সংগ্রহ করে গুড়-পাটালি তৈরি করা হচ্ছে। শীতকালে খেজুর রস ও গুড়ের জন্য এরই মধ্যে সুখ্যাতি পেয়েছে রাজশাহী। এখানে প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের সংসার চলছে খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে। আগামীর কৃষি অর্থনীতির জন্য সব সম্পদের ব্যবহারের অনুরোধ করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।