টাঙ্গাইল (ঘাটাইল) থেকে: আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে খামারি, প্রান্তিক কৃষক, দালাল, ফড়িয়াসহ কোরবানির গরু মোটাতাজা করতে বিষাক্ত স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সারা দেশের মতো টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার খামারি ও কৃষকরাও এর থেকে পিছিয়ে নেই।
গারো বাজার, মোটের বাজার, মাইধারচালা, ফুলমারীর চালা, সাগরদিঘী, আনেহলা, রসুলপুর, দেওজানা, দীঘলকান্দিসহ ঘাটাইলের বারটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বেশ কিছু এলাকার খামার ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র উঠে এসেছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লিকলিকে চিকন ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল গরু বাজার থেকে অল্প টাকায় ক্রয় করে কোরবানির আগে গরুকে দ্রুত স্বাস্থ্যবান করতে স্টেরয়েড, হরমোন, উচ্চ মাত্রার ভিটামিন অথবা রাসায়নিক দ্রব্য ইনজেকশনের মাধ্যমে পুশ করে কিংম্বা খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে তারা গরুর দেহে প্রবেশ করাচ্ছে।
এভাবে ভয়ঙ্কর এই পন্থা অবলম্বন করা গরু জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও পশু স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা দেশের স্বনামধন্য এনজিও প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা।
পাশাপাশি তারা সতর্ক করে বলেছেন, গরু কেনার আগে ভালো গরুটি চেনার জন্য সচেতনতা প্রয়োজন। সঠিক ভাবে গরু চিনতে না পারলে গরুর মাংস হতে পারে আমার/আপনার জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। গরুর পেছনে যে ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে সেটা বাজার থেকে বিষ কিনে সরাসরি গরুর দেহে প্রবেশ করানো হচ্ছে।
নিরাপদ গরু-মহিষ কীভাবে চেনা যাবে জানতে চাইলে তারা বলেন, সাধারণত অস্বাভাবিক মোটাতাজা গরু অস্বাভাবিক স্থূল দেখায়, নিচের অংশে পানি জমে থাকে, মাংস পেশিতে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে আঙ্গুল ডেবে থাকে। চোখে নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো ঝিমুনির ভাব থাকে। চঞ্চলতা থাকে না। গতিবিধি থাকে নিস্তেজ ধরনের, রোদে থাকতে পারে না, ঘন ঘন পানি খায় ও ঘন ঘন প্রস্রাব করে।
ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো কোরবানি করা। মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মুসলমানরা কোরবানি দিয়ে থাকেন। কিন্তু অত্যন্ত উদ্বিগ্নতার সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যে, কোরবানির ঈদ আসলেই অধিক মুনাফা লাভের আশায় গরু-মহিষ মোটা তাজাকরণে বিভিন্ন ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার করে। এসব গরু-মহিষের মাংস খাওয়ার ফলে কিডনি, লিভার হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি, মুখ, গলা, ঘাড় ও পেটে অতিরিক্ত চর্বি জমে স্টেরয়েডে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি করে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত থেকে যায়।
অতিরিক্ত স্টেরয়েড অস্থিক্ষয় ও মাংসপেশি ক্ষয়জনিত জটিল রোগ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে হাত-পায়ের মাংসপেশিতে টান পড়তে পারে, বেশি দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়ে অস্টিওপোরোসিস রোগ দেখা দেয়। এ ছাড়া চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত ডাইক্লোফেনাক ইনজেকশন পুশ করা গরুর মাংস খেলে কিডনি রোগসহ লিভার, বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিকলাঙ্গসহ লিভার ফেইলিউরের ঘটনা ঘটতে পারে। এতে করে লিভার-কিডনি দুটোই আক্রান্ত হয়ে ক্যান্সার হতে পারে। মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
খাবার ও ইনজেকশনের মাধ্যমে গরুর দেহে ক্ষতিকর ওষুধ প্রয়োগের মধ্য অন্যত্তম হচ্ছে ভারতীয় পামবড়ি ও স্টেরয়েড, প্রি-ডেক্সানল, ডেক্সামেথাসেন, বেটামেথাসন, পেরিঅ্যাকটিন, প্যারাডেক্সা, ওরাডেক্সসন ও ড্রাইক্লোফেনাক অন্যত্তম। এসব ওষুধ বিভিন্ন ফার্মেসি কিংবা হাটে-বাজারে সবখানেই প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গারোবাজার এলাকার একজন খামারি জানান, গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সারা বছর গরু পালন করে তেমন লাভ হয় না। তাই তার মতো অনেক খামারি কোরবানি ঈদের দিকে চেয়ে থাকেন। ঈদ ঘনিয়ে আসলেই শুরু হয় গরু মোটাতাজা করণের প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন ইনজেকশন প্রয়োগ ও ওষুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি ইউরিয়া সারও খাওয়ানো হয়।
ধলাপাড়া বাজারের গরু ব্যবসায়ী মোতাহার আকন্দ জানান, এ সময় ওষুধ বা ইনজেকশন না দিলে গরু পালন করে আমাদের পোষায় না। তাই অধিক লাভের জন্যই আমাদের এ কাজটি করতে হয়।
তিনি বলেন, মাঠে চড়ানো গরু বিক্রয়যোগ্য করতে যেখানে সময় লাগে ১৮০ দিন, সেখানে কৃত্রিমভাবে বা বাণিজ্যিকভাবে একটি গরু বিক্রয় যোগ্য করতে সময় লাগে মাত্র ৩০ থেকে ৬০ দিন।
ঘাটাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল মান্নানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বলতে দ্বিধা নেই ঈদ আসলেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন স্টেরয়েড হরমোন, প্রি-ডেক্সানল, ডেক্সামেথাসন, বেটামেথাসন, ওরাডেক্সসন ও ড্রাইক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করে বেশি মুনাফা লাভের আশায় দণ্ডনীয় এসব অপরাধ করে থাকেন। পুরো উপজেলায় ৯শ খামারি আছে। আমরা তাদের সতর্ক করে দিয়েছি ও খোঁজখবর রাখছি। আশা করছি, এবারের ঈদে সম্পূর্ণ ভেজালমুক্ত, মেডিসিনমুক্ত প্রায় ৩০ হাজার গরু আমরা বিক্রি করতে পারবো।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন