গরুর খাবার গ্রহণ ও হজম প্রক্রিয়া

1443

গরুর খাবার গ্রহণ ও হজম প্রক্রিয়া:

২য় খন্ড (পার্ট-২)

১। মুখ (Mouth):
গরু আশঁ জাতীয় খাবার; যেমন: ঘাস, খড় ইত্যাদি ও দানাদার খাবার খাওয়ার সময় এমন ভাবে চর্বণ (Chewing) করে যাহাতে তা সহজে খাদ্যনালী দিয়ে পাকস্থালীতে (মুলত রুমেন ও রেটিকুলামে) পৌন্ছায়। এসময় গরুর মুখে লালা (Saliva) নিঃসৃত হয় (Salivary Gland থেকে), যাহা খাবারকে পিচ্ছিল করে ও খাদ্যনালী দিয়ে যেতে সহায়তা করে। এই Saliva এর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, গরুকে দানাদার খাবার বা সাইলেজ খাওয়ানো হলে পাকস্থালীর (রুমেন) মাইক্রোঅর্গানিজম প্রচুর পরিমানে এসিড (Volatile Fatty Acid) নিঃসরণ করে। Saliva তখন পাকস্থলীর এসিটিক pH কে নিষ্কৃয় ( Neutralize) করে পাকস্থালীর pH কে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখে ফলে হজম প্রক্রিয়া সব থেকে ভাল হয়। Saliva এর pH হলো উচ্চ সোডিয়াম বাইকার্বনেট এর সমকক্ষ ফলে পাকস্থালী তে Buffering effect এর জন্য Saliva খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; পাশাপাশি ব্লট (ফেনাযুক্ত গ্যাস) এর ঝুকিঁ কমায়। জাবরকাটার (Cud/Rumination) প্রক্রিয়া ঠিকমত সম্পন্ন করার জন্যও এই লালা (Saliva) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পাকস্থালীর আদর্শ pH= ৫.৫ থেকে ৭
মুখের লালার pH= ৬.২ থেকে ৮.২
#একটি গরু দিনে ৫০+ লিটার লালারস (Saliva) উৎপন্ন করে খাদ্য গ্রহন ও জাবর কাটার জন্য। Saliva কম বেশি হওয়া নির্ভর করে আশঁজাতীয় ও দানাদার খাবারের পরিমানের উপর ভিত্তি করে।

২। খাদ্যনালী (Esophagus):
মুখে চর্বণযুক্ত লালারস মিশ্রিত খাবার পাকস্থালীতে যে টিউবের মত রাস্তা দিয়ে ২/৩ সেকেন্ডের মধ্যে প্রবেশ করে সেই Mascular tube কেই খাদ্যনালী (Esophagus) বলে।

৩। চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট পাকস্থলী (Four Compartment Stomach):

#রুমেন ( Rumen): গরুর পাকস্থালীর চার প্রকোষ্ঠের মধ্যে বড় প্রকোষ্ঠির নাম হলো রুমেন।
রুমেনকে খাবার জমা রাখার গোডাউন বলতে পারেন! গরুর সাইজ অনুযায়ী রুমেনের সাইজ ভলিউম ১০০ লিটার থেকে ২০০ লিটার পর্যন্ত হয়। রুমেনে রুমেন মাইক্রোফ্লোরা এর পাশাপাশি লক্ষাধিক মাইক্রোঅর্গানিজম/ব্যাকটেরিয়া থাকে যাহা খাবার হজম প্রক্রিয়া (আংশিক) ও নিউট্রিয়েন্ট শোষণে সহায়তা করে। ভাল রুমেন থেকেই রুমেন ফ্লোরা গুলো প্রাকৃতিক ভাবেই Vitamin K & All B Vitamins তৈরি করে।
রুমেন ফ্লোরা/মাইক্রোঅর্গানিজম মুলত দানাদার খাবার (Simple Carbohydrates) ও আশঁ জাতীয় খাবার (Complex Carbohydrates) কে মাইক্রোবিয়াল হজম (গাজঁন) প্রক্রিয়ায় ভেঙ্গে Volatile Fatty Acids (VFAs) ও এ রূপান্তর করে এবং কিছু গ্যাস উৎপন্ন হয় যাহা খাদ্যনালী দিয়ে বের হয়ে যায়। VFAs রুমেনে শোষিত হয়ে এনার্জির উৎস হিসেবে কাজ করে ও গরুর শরীরপ্রক্রিয়া কার্যাবলী (Maintenance), শারীরিক বৃদ্ধি (Growth), প্রজনন (Reproduction) ও গাভীতে দুধ উৎপন্নে (Milk Production) এ সহায়তা করে।
VFAs- Acetic Acid, Propionic Acid & Butyric Acids সমন্বয়ে গঠিত।
আশঁ জাতীয় খাবার থেকে Acetic Acid= 60-70%, Propionic Acids= 15-20% and Butyric Acids= 5-10% উৎপন্ন হয়।
অন্যদিকে দানাদার খাবার থেকে Acetic Acid= 40%, Propionic Acids= 40-50% and Butyric Acids= 10% উৎপন্ন হয়।
আদর্শ রুমেন pH= 6-7.

#রেটিকুলাম (Reticulum):
আশঁজাতীয় ও দানাদার খাবার প্রথমে রুমেন এ এসে এখানে মাইক্রোবিয়াল হজম প্রক্রিয়া শেষে রেটিকুলাম চেম্বারে যায় সেখান এটি আবারও মুভমেন্ট করে মুখে যায় যাহাকে আমরা জাবরকাটা বলে থাকি। জাবরকাটা (Rechewing) শেষে ইহা আবারও রেটিকুলাম হয়ে ৩য় চেম্বার ওমেজাম (Omasum) প্রবেশ করে।

#অমেজাম (Omasum):
এটি ৩য় চেম্বার। এখানে পাচঁক খাবার থেকে পুনরায় অবশিষ্ট VFA ও নিউট্রিয়েন্ট (পটাশিয়াম ও সোডিয়াম) শোষিত হয় পাশাপাশি পাচঁক খাবারের ৪০-৬০% জলীয় অংশও শোষন করে। এর পর কম জলীয়অংশ বিশিষ্ট পাচঁক খাবারকে ৪র্থ চেম্বার এবোমেজামে (Abomasum) প্রেরণ করে।

#এবোমেজাম (Abomasum):
এখানে Gastric Juice উৎপন্ন হয়। এখানে pH= 2-3. এটি নন রুমিনেন্ট পাকস্থালীর মতই কাজ করে বলে একে True Stomach বলা হয়। এখানে প্রচুর লালাগ্রন্থি (Gland) থাকে, যাহা থেকে HCL এসিড ও হজমকারক এনজাইম নিঃসরিত হয় ও আংশিক পাচঁক খাবার কে পুনরায় কেমিকেল প্রক্রিয়ায় ভেঙ্গে ইহা হতে খাবারের প্রোটিন কে শোষন করে।

৪র্থ খন্ড (শেষ খন্ড)

ফিল্ড রিলেটেড কিছু প্রশ্ন ও উত্তরঃ
১। প্রশ্নঃ দানাদার খাবার শুকনো খাওয়াবো না পানিতে গুলিয়ে খাওয়াবো?
– গরুর খাবার গ্রহন ও হজম প্রক্রিয়ায় আমরা জেনেছি, খাবার গ্রহন ও হজমে মুখের লালা (Saliva) কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যখন আপনি দানাদার খাবার শুকনো খাওয়াবেন তখন মুখে প্রচুর Saliva নিঃসরিত হবে যাহা কার্যকর হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।
Saliva রুমেনের pH কে স্বাভাবিক রাখে পাশাপাশি রুমেনে ফেনাযুক্ত (Bloat) গ্যাস উৎপন্ন হতে বাধা প্রদান করে।
তাই দানাদার খাবার শুকনো খাওয়ানো জরুরী।

২। প্রশ্নঃ গরুকে পানি কতটুকু খাওয়াবো?
– গরুকে তার প্রয়োজন মত পানি খাওয়ানোর অভ্যেস করুন। দানাদার খাবার বা আশঁ জাতীয় খাবার খাওয়ানোর ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা পর পর্যাপ্ত পরিষ্কার পানি নিশ্চিত করুন। গরুর খামারে এই গরমে সবসময় পরিষ্কার পানি নিশ্চিত করুন।
মনে রাখবেন, পানি খাওয়ানোর সাথে গরুর পেট মোটা বা বড় হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই।
বেশি পানি খেলে গরুর পেট বড় হবে; এটি ভ্রান্ত ধারনা।

৩। প্রশ্নঃ গরু কে ঘাস, খড়, সাইলেজ খাবারগুলো কিভাবে খাওয়াবো? কি পরিমানে খাওয়াবো?
– ১০০ কেজি ওজনের একটি গরুকে (২৪ ঘন্টায়):
> ঘাস= ৪.৫-৫ কেজি
> খড়= ১.৫-২ কেজি
> সাইলেজ= ৩-৪ কেজি (ঘাসের বিকল্প হিসেবে সাইলেজ খাওয়ালে খড় না খাওয়ালেও চলবে)।

৪। প্রশ্নঃ গরুকে দিনে কতসময় ধরে খাবার খাওয়াবো?
– গরুর হজম প্রক্রিয়া থেকে আমরা জেনেছি, গরু জাবরকাটা প্রাণী। জাবরকাটা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হলে খাবারের হজম প্রক্রিয়া ভাল হয়। তাই গরুকে ভাল হজমপ্রক্রিয়ার জন্য জাবরকাটা ও বিশ্রামের জন্য সময় দিতে হবে। একটি গরু দিনে ৮ ঘন্টা জাবরকাটার কাজটি করে থাকে।
গরুকে দিনে ৩ বেলা খাবার খাওয়ানো ভাল।
> সকালে- ৪০%
> দুপুরে (১২টা)- ২০%
> বিকেলে> ৪০%
রাতে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। মনে রাখবেন বেশি খাবার দিলেই গরুর মাংস ব দুধ বৃদ্ধি পাবে না বরং ভাল হজম প্রক্রিয়া গরুর দুধ ও মাংস বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

৫। প্রশ্নঃ গরু জাবর কাটার সময় মুখ দিয়ে খাবার পড়ে যায়?
– এটি অনেক কারনেই হয় (একজন ডিভিএম ডাক্তারের পরামর্শ নিন)।
আগাছা যুক্ত ঘাস গরুকে সরবরাহ করলে এমন হতে পারে। বিভিন্ন আগাছাতে Alkaloids থাকে যা গরুতে বমি (Vomiting) পর্যন্ত ঘটাতে পারে।

৬। প্রশ্নঃ গরুকে কতটুকু সময় বিশ্রাম দিবো?
– গরুর খাবারের পরিমান হিসাব করে সেটি ২/৩ বেলায় গরুকে সরবরাহ করুন। বাকি সময় গরুকে জাবরকাটা ও বিশ্রামের জন্য দিয়ে দিন। রাতে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা গরুকে বিশ্রামের ব্যবস্থান করুন।

৭। প্রশ্নঃ চাল ভাঙ্গা অর্ধসিদ্ধ করে খাওয়ানো যাবে কি না?
– মানুষের খাবার গরুকে খাওয়ানোর ভুল পন্থাগুলো বন্ধ করুন। মানুষের হজম প্রক্রির ও গরুর হজম প্রক্রিয়া সম্পুর্ন ভিন্ন।
আমরা জেনেছি যে গরু জাবরকাটা প্রানী। এরা আশঁজাতীয় খাবারের সেলুলোজ থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি তৈরি করে যাহা Volatile Fatty Acid (VFA) হয়ে রুমিনাল ওয়ালে শোষিত হয়। চালভাঙ্গা স্টার্চ জাতীয় খাবার; যা অর্ধসিদ্ধ করে গরুকে খাওয়ালে তা গাজঁন প্রক্রিয়ায় রুমেনে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করবে ফলে রুমিনাল PH এর তারতম্য ঘটে হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে ব্লট (Frothy Gas) হবে। এতে গরু মারাও যেতে পারে।

৮। প্রশ্নঃ গরুর হজমশক্তি কেন ভাল হয় না?
-গরুর হজম শক্তি ভাল না হওয়ার কিছু কারন-
> গরুকে পরিমানের থেকে বেশি খাবার সরবরাহ করা হলে।
> খাবার খাওয়ানোর পন্থা সঠিক না হলে।
> গরুকে নিয়মিত সঠিক ডোজে কৃমিনাশক প্রয়োগ করে কৃমিমুক্তকরণ না করলে।
> গরুর রেশনে প্রোবায়োটিক না রাখলে।

৯।প্রশ্নঃ গরু প্রচুর খায় কিন্তু স্বাস্থ্য/মাংস ভাল হয় না; কি করনীয়?
– পুষ্টিমান ব্যালেন্স রেশন খাবার গরুকে সরবরাহ করতে হবে।
– আশঁজাতীয় খাবার; যেমন ঘাস ও খড় একসাথে ও ফিড মিক্স করে একসাথে গরুকে সরবরাহ করুন। খাবার খাওয়ানো ১৫-২০ মিনিট পর পরিষ্কার পানি গরুকে দিন।
এতে গাভীর দুধ বৃদ্ধি পাবে তেমনি মাংসের গরুর দ্রুত মাংস বৃদ্ধি পাবে। এই পদ্ধতিকে Total Mixed Ration (TMR) বলে। ডেইরী শিল্পে উন্নত বিশ্বে এই TMR মেথডে গাভীকে/ষাঁড় কে খাবার খাওয়ানো হয়।

ডাঃমোঃ শাহ্-আজম খান
সিনিয়র কাস্টমার সার্ভিস অফিসার
নারিশ পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারী লিমিটেড।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২২সেপ্টেম্বর২০