গরু পালনে সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় করণীয় সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই জানা নেই। আমাদের দেশে গবাদিপশু তথা গরু পালন একটি লাভজনক পেশা। গরু পালন করে অনেকেই তাদের দারিদ্রতা দূর করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। গরু পালনের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসুন জেনে নেই গরু পালনে সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় করণীয় সম্পর্কে-
গরু পালনে সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় করণীয়ঃ
১। প্রতিদিন পশুকে গোসল করাতে হবে এবং সাথে ব্রাস করলে ভাল হয়। এতে শরীরের পশম উজ্জ্বল ও চকচকে হয়।
২। খাদ্য পরিবেশনার উপরও গরুর খাদ্য গ্রহণের তারতম্য হয়। যেমন-
নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন খাদ্য সরবরাহ করা।
গরুর সম্মুখে সর্বদা খাদ্য রাখা।
খাদ্য সরবরাহের আগে অবশ্যই পাত্র পরিষ্কার করা।
দানাদার খাদ্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ মেপে ২ বারে (সকালে ও বিকালে) পরিবেশন করা।
দানাদার খাদ্য আধা ভাঙ্গা অবস্থায় ভিজিয়ে খেতে অভ্যস্ত হলে সেভাবে দেয়া।
শুকনা দানাদার খাদ্য দিলে খাদ্য গ্রহণের পরপরই পানি দেয়া।
খড় কেটে ভিজিয়ে পরিবেশন করলে কম নষ্ট হয় এবং খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে ।
খাদ্যে অবশ্যই মাটি/বালি থাকা খাদ্য পচা, বাসি, অতি পুরাতন না হওয়া।
৩। গরু যদি নিজ ইচ্ছায় নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার না খায় তবে বাঁশের চোঙা বা প্লাস্টিকের বোতলে করে জোর করে পেট ভর্তি করে খাওয়ানো যাবে না।
৪। প্রয়োজনের অতিরিক্ত নড়াচড়া করতে দেওয়া যাবে না।
৫। কোন প্রকার কাজে খাটানো যাবে না।
৬। উত্তেজিত বা বিরক্তত করা যাবে না।
৭। মশা-মাছি, আটালী থেকে পশুকে রক্ষা করতে হবে।
৮। পশুর কাছে সব সময় টিউবয়েলের টাটকা পানি থাকবে।
৯। বাসস্থান সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
১০। সপ্তাহে একদিন বাসস্থান, খাবার পাত্র জীবাণুনাশক ঔষধ যেমন আয়োসান (Iosan), সোডা, ডেটল/ স্যাভলন দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে।
১১। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আলো বাতাস ঘরে রাখতে হবে।
১২। খাদ্য সংরক্ষণের জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে ইঁদুর বা কুকুর নষ্ট না করে।
১৩। দৈহিক ওজনের উপর ভিত্তি করে দানাদার খাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
১৪। নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ দিতে হবে।
১৫। প্রতিদিন পরিমাণমত কাঁচা ঘাস ও খড় দিতে হবে।
১৬। প্রতিনিয়ত বি- ভিটামিন দিতে হবে।
১৭। সময়মত সংক্রামক রোগ সমূহের টিকা দিতে হবে।
১৮। বাহিরের লোকজনকে গরুর কাছে যেতে দেওয়া যাবে না।
১৯। সপ্তাহে একবার গরুর ওজন নিতে হবে।
২০। পশু অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে নিটস্থ পশু হাসপাতালে নিতে হবে।
গরুর খামারের ব্যবস্থাপনাঃ
যথাযতভাবে খামার ব্যবস্থাপনা করা লাভজনক গবাদি পশু পালনের মুল চাবি কাঠি। একটি খামার মানসম্মত ভাবে, সঠিক উপায়ে, লাভজনক ভাবে এবং সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করার নামই খামার ব্যাবস্থাপনা। খামার ব্যবস্থাপনায় নিম্ন বর্নিত বিষয় সমুহের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে-
খামারের স্থান নির্বাচনঃ
আমরা পরিবার ভিত্তিক ক্ষুদ্র খামার স্থাপনের জন্য আমাদের বাড়ির অ-ব্যবহারিত স্থান বেছে নিতে পারি। এ স্থানটি সাধারনতঃ বাড়ীর পুর্ব অথ বা পশ্চিম দিকে হলে ভাল হয়। সর্ব মোট ১০ টি গরুর জন্য ৩০০ বর্গ ফুট জায়গার প্রয়োজন। গরুর ঘর থেকে ২০/২৫ ফুট দূরে একটি ছোট ডোবা থাকবে যাতে সেখানে গরুর মল-মূত্র ফেলা যায়। এ ছাড়া মল মুত্র থেকে জৈব সার ও বায়ো গ্যাস উৎপাদনের জন্য বায়ো গ্যাস প্লান্ট স্থাপন করে লাভজনক ভাবে খামারের বর্জ ব্যবস্থাপনা করা যায়।
গরুর শেড নির্মানঃ
একটি পুর্ন বয়স্ক গরুর জন্য সর্ব সাকুল্যে ২৮ থকে ৩০ বর্গ ফুট জায়গার প্রয়োজন হয় । এ হিসেবেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক গরুর জন্য শেড নির্মান করতে হবে। গরুর শেড পূর্ব – পশ্চিমে লম্বা হলে ভাল হয়। শেডের ফ্লোর, খাবার পাত্র, পানিরপাত্র ইত্যাদি পাকা হওয়া প্রয়োজন। উপরে টিন অথবা ছনের ছাউনি দেওয়া যেতে পারে। শেডের নিকটস্থ গাছ ও ডালপালা কেটে ফেলে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে। শেডে পানীয় জলের সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশনের ব্যাবস্থা থাকতে হবে। খামারের চারপাশে উচু মজবুত বেষ্টনী তৈরী করতে হবে যাতে চোরের হাত থেকে খামারের গরু ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিষ-পত্র রক্ষা করা যায়।
গোবর/ বর্জ্য ব্যবস্থাপনাঃ
গোবর গবাদি পশু থেকে পাওয়া একটি অর্থকরী সম্পদ। গোবর থেকে আমরা বায়ো গ্যাস ও জৈব সার উৎপাদন করতে পারি যা থেকে জ্বালানী ও ফসলি জমির উৎকৃ্ষ্ট সারের চাহিদা পুরন করা সম্ভব। এ ছাড়া , মাছের জলজ খাদ্য উৎপাদনে পুকুরে গোবর ব্যবহার করা হয় ।
জনবলঃ
খামার সফল ভাবে পরিচালনার জন্য খামারের কাজ করতে আগ্রহী দক্ষ, উদ্দ্যোগি, কর্মঠ , উদ্যোমি, সৎ ও ত্যাগী জনবলের বিকল্প নেই। খামারের কর্ম কর্তা ও কর্ম চারিদের সময় জ্ঞান, নিয়মানুবর্তিতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হতে হবে। তাই খামারের কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়োগের সময় উল্লেখিত সৎ গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে হবে।
হিসাব সংরক্ষনঃ
খামার পরিচালনায় হিসাব সংরক্ষনের গুরুত্ব অপরিসীম। খামারের প্রতিটি খরচ ভাউচার সহ সংরক্ষন ও তা নথিভুক্ত করা প্রয়োজন। খামারে উৎপাদিত পণ্য সমুহ বিক্রয়ের রেজিষ্টার সংরক্ষন ও বিক্রয় রশিদের মাধ্যমে সকল বিক্রয় সম্পাদন করতে হবে। প্রতিদিন ক্যাশ বই, লেজার বহি, ক্রয় বহি, বিক্রয় বহি ও স্টক বহি ইত্যাদি যথাযত ভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে আয় ও ব্যয় হিসাব তৈ্রী করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা, করে যথা সময়ে যথাযত সিদ্ধান্ত গ্রহন ও তা কার্যকর করতে হবে।
খামারের সুস্থ্য পরিবেশ বজায় রাখাঃ
খামারের অভ্যন্তরে ও চারিপাশে স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী। স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে প্রতিদিন নিয়মিত গাভীর শেড পরিস্কার করতে হবে। শেডের গোবর যথাস্থানে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে ফেলতে হবে। ড্রেনের মাধ্যমে শেডের পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং প্রতিদিন ড্রেন পরিস্কার করতে হবে। মশা, মাছি ও অন্যান্য কীট পতঙ্গের হাত থেকে গবাদিপশু রক্ষা করতে মশা মাছি ধ্বংস ব্যবস্থা নিতে হবে। মশা থেকে রক্ষার জন্য মশারির ব্যবস্থা রাখতে হবে। খামারের চারপাশে আগাছা ও ময়লা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
জীব নিরাপত্তা নিশ্চিত করাঃ
খামারকে বিভিন্ন রোগের আক্রমন থেকে রক্ষা করার জন্য খামারের জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। খামারে মানুষের প্রবেশ নিয়ন্ত্রন এবং অন্যান্য প্রাণী যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বিড়াল ও ইঁদুর ইত্যাদির প্রবেশ সম্পুর্ন ভাবে নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। কারণ উল্লেখিত জীবজন্তু রোগজীবাণুর বাহক হিসাবে কাজ করে এবং ছোয়াচে রোগ বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।