গরুর দুধ জ্বরের কারণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

3181

21752075_307767106358417_2672139325601197721_n
গরুর দুধ জ্বরের কারণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

মিল্ক ফিভার বা দুগ্ধ জ্বর: অধিক দুধ উৎপাদন, ড্রাই পিরিয়ড, প্রসবকালীন সময় এবং প্রসব পরর্বতী ১-৪ দিনের মধ্যে রক্তে ক্যালসিয়ামের অভাবে পেশীর অবসাদগ্রস্থতার লক্ষণকে মিল্ক ফিভার বা দুগ্ধ জ্বর বলে। এটি মূলত কোন জ্বর নয়। জ্বর বলতে আমরা তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে বুঝায় কিন্তু মিল্ক ফিভারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি না পেয়ে বরং কমে যায়।

কখন হয়ঃ
১. বাচ্চা প্রসবের ঠিক পরবর্তি সময়ে,
২. অধিক দুধের গরু দীর্ঘ দিন ক্যালসিয়াম ঘাটতিতে থাকলে।

মিল্ক ফিভারের কারণ সমূহঃ
১. সকল স্তন্যপায়ী প্রাণি বাচ্চা প্রসবের পূর্বে মেমারি গ্লান্ড রক্ত থেকে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম শোষন করে Colostrum বা শাল দুধ তৈরি করে। Colostrum বা শাল দুধে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ সাধারণত ৮ থেকে ১০ গুন বেশি থাকে। রক্তে দ্রুত ক্যালসিয়ামের ঘনত্ব কমে যাওয়া এবং ক্যালসিয়াম শোষন পর্যান্ত না হওয়ার কারণে গরুর মিল্ক ফিভার বা হাইপোক্যালমিয়া বা দুগ্ধ জ্বর হয়।
২. গোনাডাল হরমোনের অাধিক্যের কারণে শরীরে হাড় গঠনের মাত্রা বেড়ে গেলে মিল্ক ফিভার হতে পারে।
৩. রেশনের ক্যাটায়নের পরিমাণ বিশেষত K(+) এর পরিমাণ বেড়ে মিল্ক ফিভার হতে পারে।
৪. মেটাবলিক ডিজওর্ডারের কারণে ক্লিনিক্যাল বা সাব-ক্লিনিক্যাল মিল্ক ফিভার হতে পারে।
৫. রেশনে মিনারেল ও ভিটামিনের ঘাটতি বা আধিক্যের কারণেও মিল্ক ফিভার হতে পারে।

ক. Low Calcium Intake: রেশনে ড্রাই ম্যাটারের ০.৪% এর কম ক্যালসিয়াম থাকলে মিল্ক ফিভার হতে পারে। বিশেষত গাভীর ড্রাই পিরিয়ডে এমন হলে সমস্যা হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে।

কারণঃ
i. প্রচুর পরিমাণে ভূট্টার সাইলেজ খাওয়ালে,
ii. উচ্চ আদ্রতাযুক্ত ভূট্টা খাওয়ানো,
iii. পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট না দেওয়া,
iv. কম কাঁচা ঘাস ও বেশি দানাদার খাওয়ানো,
v. পরিমাণের চেয়ে কম খাবার দেওয়া।

খ. Low Phosphorous Intake: রোশনে ড্রাই ম্যাটার হিসাবে ০.২৮% এর চেয়ে কম ফসফরাস থাকা।

কারণঃ বেশি পরিমাণ ঘাস খাওয়ানো এবং অত্যন্ত কম দানাদার দেওয়া। বিশেষত মাঠে চড়ে খাওয়া গরুর এ জাতীয় সমস্যা হতে পারে।

গ. অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম প্রদানঃ রেশনে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের কারণেও মিল্ক ফিভার হতে পারে। রেশনে ক্যালসিয়ামের স্ট্যান্ডার্ড মাত্রা হল ০.৪৩-০.৭৭%।

ঘ. অতিরিক্ত ফসফরাস প্রদানঃ অতিরিক্ত ফসফরাসের কারণেরও মিল্ক ফিভার হতে পারে। রেশনে ফসফরাসের স্ট্যান্ডার্ড পরিমাণ হল ০.২৮-০.৪৯। তবে ০.৪% এর বেশি না দেওয়াই উত্তম। প্রয়োজনের অধিক পরিমাণে ডিসিপি প্রদান।

ঙ. অতিরিক্ত ভিটামিন ডি প্রদানঃ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন ডি প্রদান করলেও সমস্যা হতে পারে। প্রতিদিন মোট 100,000 IU এর বেশি দেওয়া যাবে না। অতিরিক্ত ভিটামিন এর কারণে জার্ট ফেইলুর হতে পারে।

চ. Low Magnesium Intake: রেশনে ০.২0% এর কম।ম্যাগনেসিয়াম থাকলে মিল্ক ফিভার হতে পারে। কারণ ক্যালসিয়াম শোষনেন সাথে ম্যাগনেসিয়ামেরর সম্পর্ক রয়েছে।

ছ. High Potassium Intake: উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম থাকলে রক্তে ক্যাটায়নের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই রেশনে ১.২% এর বেশি পটাশিয়াম থাকলে মিল্ক ফিভার হতে পারে।

জ. রুমেন ph বেড়ে গেলে মিনারেল শোষন কমে গিয়ে মিল্ক ফিভার হতে পারে।

ঝ. ভিটামিন ডি এর ঘাটতির কারণে ক্যালসিয়াম এ ফসফরাসের শোষন সমস্যা হবে। এতে মিল্ক ফিভার হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি।

ঞ. ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের ব্যালান্স না থাকা। ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অনুপাত হওয়া উচিত ২:১। যদিও এটি কম বেশি হতে পারে।

ট. ভিটামিন ই ও সেলেনিয়ামের ঘাটতির কারণে। দৈনিক চাহিদা ভিটামিন ই ২৫০ IU, সেলেনিয়াম ০.১০ ppm.

ঠ. এছাড়াও শরীরে দীর্ঘ মেয়াদি ইনফেকশান, বাচ্চা প্রসব কালে কোন সমস্যা দেখা দিলে মিল্ক ফিভার হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

মিল্ক ফিভারের লক্ষণ সমূহঃ মিল্ক ফিভার বা দুগ্ধ জ্বর কে ক্লিনিক্যাল সাইন অনুযায়ী তিন স্টেজে ভাগ করা যায়-

প্রথম স্টেজের লক্ষণ সমূহ সাধারাণত চোখে পড়ে না কারণ এর সময় কাল ১ ঘন্টার চেয়েও কম। প্রথম স্টেজে যে লক্ষণ সমূহ দেখা যাবে-
১. খাবার গ্রহণের চাহিদা বেড়ে যাবে,
২. মাংস পেশী টানবে অর্থাৎ খিচবে,
৩. শরীরের ইমিনিউ সিস্টেম ঠিক মত কাজ করবে না ফলে এলার্জি দেখা দিতে পারে, গরুর মধ্যে অসস্তি দেখা যাবে যাকে Hypersensitivity বলা হয়ে থাকে।
৪. শরীরে দূর্বলতা দেখা দিবে,
৫. শরীরের ভার বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন পায়ের উপর দিবে,
৬. পা উচু না করে মাটি বা ফ্লোর টেনে হাটবে।

মিল্ক ফিভারের দ্বিতীয় ধাপ ১ থেকে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত থাকে। এই স্টেজে রোগ ধরতে পারলে সহজেই চিকিৎসা করা যায়। এই স্টেজে গাভীর লক্ষণ সমূহঃ
১. মিল্ক ফিভারে আক্রান্ত গাভী দ্বিতীয় স্টেজে তার মাথা ডানে, বামে ঘুরাবে, দুই পায়ের মাঝ খানে রেখে নিয়ে রাখবে। মাঝ মাঝে গলা লম্বা করে টান টান করে রাখবে।
২. গাভীর কান ও নাক ঠান্ডা হয়ে যাবে।
৩. গরুর নড়া চড়া একটু কমে যাবে, শারীরিক দূর্বলতা প্রকাশ পাবে।
৪. মাংস পেশী নাচতে থাকবে যেমন আমরা জবাই এর পরও অনেক সময় দেখে থাকি।
৫. এই স্টেজে হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দিবে এবং পায়খানা আগের তুলনায় কঠিন হয়ে যাবে।
৬. শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রির নিচে নেমে যাবে।
৭. হৃদ কম্পন প্রতি মিনিটে ১০০ এর মত হয়ে যাবে।
৮. দ্বিতীয় স্টেজে আক্রান্ত গাভী প্রথম স্টেজের যেকোন বা সব গুলো লক্ষণও দেখা যেতে পারে।

এই স্টেজে গাভীর অবস্থা মারাত্নক অবনতি হয়ে থাকে। যা বাংলাদেশে হরহামেশায় হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম ও দ্বিতীয় স্টেজে মিল্ক ফিভার ধরা পরে না। শুধুমাত্র কিছু অভিজ্ঞ খামারীরা এটা বুঝতে পারে।
এ স্টেজের লক্ষণ সমূহঃ
১. দাড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে,
২. আস্তে আস্তে জ্ঞান হারাতে থাকে এবং ধীরে ধীরে কোমার দিকে চলে যায়।
৩. হার্ট বিট একটু খেয়াল করলে মৃদু ভাবে শোনা যায়,
৫. হার্ট বিট মিনিটে ১২০ বারের মত হয়ে থাকে।
৬. এই স্টেজে বিনা চিকিৎসায় ৩/৪ ঘন্টা থাকলে অসুস্থ গাভীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে উঠে।

তথ্য সূত্র।
AH Joarder
Dairy Development & Nutrition Research Institute

ফার্মসএন্ডফার্মার/১১মার্চ২০