চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার উপক‚লীয় রায়পুর ইউনিয়নের শঙ্খ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় রয়েছে বন বিভাগের সংরক্ষিত গহিরা প্যারাবন। এই নদী আর সাগরের গুরুত্বপূর্ণ মোহনায় বিস্তৃত এই ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করে তৈরি করা হয়েছে মাছের ঘের। বন বিভাগের তথ্যমতে, যার পরিমাণ ৯৫ একর। সাগরের তীরঘেঁষে বন বিভাগের চিহ্নিত গাছসহ চারদিকে মাটির বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একাধিক মাছের ঘের।
বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতায় স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির ইন্ধনে বন ধ্বংস করে এভাবে মাছের ঘের করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে জহুর আহমেদ ওরফে জকু মাঝি নামের স্থানীয় এক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রায়পুর ইউনিয়নের শঙ্খ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় উপক‚লীয় এলাকার প্রবহমান এই নদী ও সাগরের দুই পাড়েই রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ। সাগর আর নদীর বাঁধ তীরবর্তী এলাকায় রয়েছে বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বন। এর বাইরে বন বিভাগ করেছে ঝাউ বন। এই বনে রয়েছে কেওড়া, ছইলা ও কিছু বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরে গহিরা ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের শত শত গাছ কেটে দখলকারীরা বনের ৯৫ একরের বেশি জায়গা মাছের ঘেরে পরিণত করায় এই বন এখন মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে। পারকির মতো হেলে পড়ছে বনের পর্ব দিকের শঙ্খ নদীর তীরের ঝাউগাছ। দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে সব মাছের ঘের। সাগরের নিচের অংশের বালি হারিয়ে কাদামাটিতে পরিণত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মাছ চাষ করার জন্য তারা এরই মধ্যে বনে বাঁধ দিয়ে বেশ কয়েকটি বড় বড় মাছের প্রজেক্ট স্থাপন করেছে, যা ১৯২৭ সালের বন আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বলা হয়েছে।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, প্রায় ছয় বছর আগে শুরু হওয়া এই দখলের কারণে বনের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। এভাবে বনের ভেতর মাছ চাষ করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক ঢালকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, ম্যানগ্রোভ বন চরম আবহাওয়ার ঘটনার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে এলাকাটিকে রক্ষা করে। তবে নদী আর সাগর উপক‚লকে যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে এলেও বনটির উজাড় হওয়ার বিষয়ে বন বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসন সবাই উদাসীন।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে এলাকাকে বাঁচাতে উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের চট্টগ্রাম উপক‚লীয় বন বিভাগের প্রেমাশিয়া বিটের অধীনে ২৫০ একর গহিরা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট গঠন করে এফডি। একটি প্রকল্পের অধীনে, এফডি ১৯৯১-৯২ সালে বঙ্গোপসাগর এবং শঙ্খ নদীর তীরে কেওড়া, গেওয়া, বাইনসহ প্রায় ১০ হাজার গাছ রোপণ করে ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করেছিলেন।
বন বিভাগের সংরক্ষিত জায়গায় কেন মাছ চাষের নামে বন ধ্বংস করা হচ্ছে, তা জানতে চাইলে অভিযুক্ত জহুর আহমেদ তা অস্বীকার করে বলেন, আমরা আমাদের পৈতৃক জমিতে চাষাবাদ করছি, বন বিভাগের জায়গায় নয়।
বন কেটে মাছের ঘের করা জকু মাঝিকে ইন্ধনের অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিন শরীফের বিরুদ্ধে। এ বিষয়টি তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘দস্যুদের ধ্বংসের কারণে বন মরে যাচ্ছে। এফডির বন পুনরুদ্ধার করা উচিত। আমি চাচ্ছি বনটি উদ্ধার হোক। এই বন আমাদের উপক‚ল রক্ষা করে।
চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বাঁশখালীর রেঞ্জার শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রেমাশিয়া বিট অফিসে আমাদের মাত্র দুই বনরক্ষী আছেন। এত অল্প জনবল দিয়ে এই বিটের হাজার একর বনভ‚মির দিকে নজর রাখা বাস্তবসম্মতভাবে সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর, ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের অভাবে উপক‚লের অনেক বাসিন্দার সম্পত্তি ও ঘরবাড়ি সমুদ্রে হারিয়ে যায়। এফডির দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
চট্টগ্রাম উপক‚লীয় বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাঁশখালী রেঞ্জের প্রায় এক হাজার ৩০৫ একর ম্যানগ্রোভ বন দখল করেছে এক হাজার ২৭৫ দখলদার। তার মধ্যে গহিরা উপক‚লের একজন এই জহুর আহমেদ ওরফে জকু মাঝি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড় মাটিকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর সময়ও বনটি ঝড়ের বৃদ্ধির কারণগুলোকে শোষণ করে। এছাড়া এই গাছগুলো মাছ, পাখি ও সরীসৃপদের আবাসস্থল প্রদান করে। আর এই গাছ কেটে বন উজাড় করা হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরম বিপরীত আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে হবে উপক‚লীয় মানুষসহ এই অঞ্চলের মানুষদের।
চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. বেলায়েত হোসেনের কাছে কীভাবে বনে মাছ চাষ করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাঠের কর্মীরা আমাকে এ বিষয়ে অবগত করেনি বলে আমি বনে মাছ চাষের বিষয়ে অবগত নই। তবে এভাবে মাছের ঘের করে বন ধ্বংস করা একটি অপরাধ। আইন অনুযায়ী তিনি অবশ্য বলেন, দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন তিনি।