গাভীর ওলান প্রদাহ রোগের লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ

1368

গাভীর ওলান প্রদাহকে ম্যাস্টাইটিস বা ওলান ফোলা বা ওলান পাকা রোগ বলা হয়। ডেইরি শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে কয়েকটি রোগকে অন্তরায় হিসেবে গণ্য করা হয় ম্যাস্টাইটিস বা ওলান প্রদাহ তার মধ্যে অন্যতম। এ রোগ অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ রোগে-

১. দুধ উৎপাদন কমে যায়।

২.চিকিৎসা খরচ খুব বেশি।

৩. অনেক সময় গাভী সুস্থ হয় না, ফলে বাদ দিতে (Culling) হয় বা গাভী মারা যায়।

৪. অসুস্থ গাভীকে সেবা দেয়ার জন্য অতিরিক্ত লেবার খরচ হয়।

ম্যাস্টাইটিস রোগে আক্রান্ত গাভীর দুধের উপাদান পরিবর্তন হয়ে যায়, যেমন- দুধে ল্যাকটোজ, চর্বি, ক্যাসিন ও ক্যালসিয়াম কমে যায়, বিপরীতে সোডিয়াম, ক্লোরাইড ও রক্তের আমিষ বৃদ্ধি পায়। এ রোগ একটি গাভীর যে কোনো সময় হতে পারে তবে বাছুর প্রসবের পরেই বেশি আক্রান্ত হয়।

রোগের কারণ

বিভিন্ন প্রকারের ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, মাইকোপ্লাজমা ও ভাইরাস।

সংক্রমণ

যদি শেডের মেঝে দীর্ঘ সময় স্যাঁতসেঁতে ও ভিজা থাকে ওলানের বাঁট কলুষিত মেঝে, দুধ দোহনকারীর হাত, দুধ দোহনের যন্ত্রের মাধ্যমে জীবাণু সরাসরি ওলানে সংক্রামিত করতে পারে। ওলানে বা বাটে আঘাতজনিত কারণে ক্ষত, ক্ষুরারোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষত বা দীর্ঘ সময় ওলানে দুধ জমা থাকলেও এ রোগ হতে পারে। বাঁটের মধ্যে কোনো শলা বা কাঠি প্রবেশ করালেও গাভী এ রোগে আক্রান্ত হবে।

রোগের লক্ষণসমূহ

অতি তীব্র রোগে ওলান হঠাৎ করে লাল হবে, শক্ত হবে ও ফুলে যাবে। হাত দ্বারা স্পর্শ করলে গরম অনুভূত হবে। ওলানে প্রচ- ব্যথা থাকে, গায়ে জ¦র থাকে। পানির মতো দুধ, পুঁজ বা রক্তযুক্ত দুধ বের হবে। ওলানে পচন ধরতে পারে। দুধ কালো কাপড়ে ছাঁকলে জমাট বাঁধা দুধ ধরা পড়বে। গাভী খাদ্য গ্রহণ করবে না। অনেক সময় আক্রান্ত ওলানে গ্যাংগ্রিন হয়ে (ফুলে) যায়। গাভীর মৃত্যুও হতে পারে। সেপটিসেমিয়া ও টাক্সিমিয়ার কারণে গাভী মারা যায়।

সুপ্ত সংক্রমণ এমন ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো দুধে ও ওলানে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। তবে দুধ উৎপাদন কমে যায়। দুধে ব্যাকটেরিয়া বিদ্যমান থাকে এবং দুধের উপাদান পরিবর্তিত হয়ে যায়।

পুরাতন ওলান প্রদাহ এমন ক্ষেত্রে দুধ উৎপাদন কমে যাবে, ছানা বা জমাট বাঁধা দুধ দেখা যায়। ওলান ক্রমে শক্ত হয়ে যায়। গাভীর খাদ্য গ্রহণ কমে যায়। ২-১টি বাঁট চিরতরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দুধে চোখে পড়ার মতো তেমন পরিবর্তন ঘটে না। দীর্ঘদিন পর পর অথবা একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর ওলানে প্রদাহের লক্ষণ প্রকাশ পায়। দুধে শ্বেত কনিকা ও সোসাইটিক কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুরাতন ওলান প্রদাহযুক্ত গাভী খামারের জন্য খুবই ক্ষতিকর কারণ, ওই গাভী সুস্থ গাভীকে রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।

চিকিৎসা

খুব দ্রুত রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। বিলম্বে এ রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ নিয়ে –

উন্নতমানের Antibiotic ইনজেকশন দিতে হবে মাত্রা মতো ৪-৫ দিন।
সউন্নতমানের প্রদাহনাশক বা স্টেরওয়েড জাতীয় ইনজেকশন দিতে হবে।
উন্নতমানের Teat infusion আক্রান্ত বাঁটে প্রয়োগ করতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর পর ৩-৪ দিন।
Povidon Iodin / ভালো মানের জীবাণুনাশক মাত্রামতো পানিতে মিশিয়ে দিনে ২-৩ বার ওলান ধুয়ে দিতে হবে।
অন্যান্য চিকিৎসা প্রটোকল প্রদান করতে হবে।
ওলান প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ

চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম পন্থা, একটি ডেইরি ফার্মে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা অনুসরণ করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

১. বাঁটের স্বাস্থ্যসম্মত বিধিব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। ভালো স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান হতে হবে। জীবাণুমুক্ত দুধ দোহনব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। ওলান ও বাঁটের স্বাস্থ্য ও যেকোনো রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

২. খুব দ্রুত এ রোগ শনাক্ত করতে হবে এবং দ্রুত উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। অসুস্থ গাভীকে আলাদা জায়গায় রাখতে হবে।

৩. শুষ্ক ও গর্ভবর্তী গাভীকে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও সেবা দিতে হবে। গাভীর ক্ষেত্রে (বকনা বাদে) দুধ দোহনের শেষ দিনে বাঁট সিল করে দিতে হবে।

৪. বার বার এ রোগে আক্রান্ত (২-৩ বার) গাভী, (Chronically ofteted) যেগুলোকে সম্পূর্ণ ভালো করা সম্ভব হচ্ছে না সেগুলোকে বাতিল (Culling) করতে হবে। এ জাতীয় অসুস্থ গাভী রোগের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে ফলে খামারের সুস্থ গাভীতে ছড়াতে সাহায্য করবে। সফল জনকভাবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণের এটাই একমাত্র পন্থা।

৫. দৈনিক দুধ দোহনের মেশিন পরীক্ষা করতে হবে ও খামারের ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।

একটি দুগ্ধ খামারে ওলান প্রদাহ রোগ প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত স্বাস্থবিধি মেনে চলতে হবে-

গাভীকে কাঁচা ঘাসসহ পুষ্টিকর সুষম খাদ্য দিতে হবে;
শেডের মেঝে পরিষ্কার করে ২-৩ দিন পর পর Disinpectant দিয়ে Sprey করতে হবে। মেঝেতে কোনো প্রকার গর্ত থাকা যাবে না।
বিজ্ঞান সম্মতভাবে গাভীর শেড বা ঘর তৈরি করতে হবে।
দুধ দোহনের আগে ওলান ধুয়ে নিয়ে হবে এবং প্রতিটি গাভী দোহনের আগে দোহনকারীর হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। অসুস্থ গাভীকে সবার শেষে দোহন করতে হবে।

দোহনকারীর শরীর, হাত পরিষ্কার করতে হবে, হাতের নখ অবশ্যই ছোট রাখতে হবে।
দুধ দোহনের পর ওলান ধুয়ে তারপর জীবাণুনাশক ওষুধে বাঁট চুবাতে হবে। Povidon iodin (Povin/Povisep) = 5-1.00%, Hypochlorid = 4.0%, Chlorite aceted = 0.5%

দুধ দোহনের পর গাভীর পেঁছন অংশ ধুয়ে দেয়া (Back glash)।
দোহনের পর কাঁচা ঘাস খেতে দিতে হবে যাতে করে গাভী ১-২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে বাঁটের দুধ নালী সংকুচিত হয়ে যাবে, ফলে জীবাণু প্রবেশ করতে পারবে না।

গাভীকে দৈনিক ১-২ ঘণ্টা ব্যায়াম করতে হবে।
কিছু দিন পর পর দুধ পরীক্ষা করে এ রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসা দিতে হবে।
বাটের ভেতরে শক্ত কাঠি বা Teat Syphon) না ঢুকানোই উচিত।

লেখক: কৃষিবিদ ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, ঘোড়াঘাট, দিনাজপুর।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৬মে২০