গিমাকলমি চাষাবাদ পদ্ধতি, পুষ্টি ও ভেষজগুণ

808

গিমাকলমি গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি শাকের নাম। এটি সাধারণত জলাবদ্ধ জায়গায়, নলকূপের ধারে, খাল-বিল, ডোবা কিংবা পুকুরে অনায়াসেই জন্মে। এর কাণ্ড ফাঁকা থাকায় পানিতে ভাসে। ডাঁটাগুলো ২-৩ মিটার লম্বা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি হতে পারে। এর প্রতিটি গিঁট থেকে শেকড় বের হয়। কলমিশাক দুইরকম দেখা যায়। এক ধরনের কলমির ডাঁটা লাল আর অন্যটির ডাঁটা দেখতে সাদা-সুবজ। এর কাণ্ড নরম এবং রসালো। পাতা অনেকটা লম্বাটে-ত্রিকোণাবিশিষ্ট। বীজের আবরণ শক্ত। রঙ ধূসর। প্রতিটি ফলের মধ্যে চারটি করে বীজ থাকে। কলমির ফুল দেখতে সাদা। গোড়ার দিকে বেগুনি। এর আদি নিবাস কারো জানা নেই। তবে অনেকেই মনে করেন ক্রান্তীয় এবং উপ ক্রান্তীয় অঞ্চলের এর জন্ম। সেখান থেকেই বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি গ্রীষ্মকালীন শাক। চাষের জন্য সেচ সুবিধা আছে এমন জমি নির্বাচন করতে হয়। পাতা জাতীয় এ সবজিটি খেতে সুস্বাদু। চায়নিজ খাবারে এর ব্যবহার যথেষ্ট। আমাদের দেশেও জনপ্রিয়তা কম নয়। কলমিশাক সাধারণত ভাজি হিসেবে খাওয়া হয়। তবে বড়া বানিয়ে কিংবা মাছের সাথে রান্না করে খেলে মজাই আলাদা। ভর্তা বানিয়েও খাওয়া যায়। চাষকৃত কলমিশাকের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম। লাভ বেশি। একবার বীজ বপন করলে সারাবছর শাক সংগ্রহ করা যায়। জলাশয়ে এমনিতেই যেসব কলমি জন্মে, তার জন্য নেই কোনো পরিচর্যা। নেই কোনো খরচ। সবদিক বিবেচনায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। পারিবারিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গিমা কলমি রাখতে পারে অনন্য ভূমিকা।

পুষ্টি ও ভেষজগুণ

অনেক গুণের অধিকারী শাকের মধ্যে গিমাকলমি অন্যতম। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রাম (আহারোপযোগী) শাকে ১০ হাজার ৭৪০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন আছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১ দশমিক ৮ গ্রাম, শর্করা ৫ দশমিক ৪ গ্রাম, চর্বি ০ দশমিক ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০৭ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ১১৩ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৫০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৩১২ মিলিগ্রাম, লৌহ ৩ দশমিক ৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০ দশমিক ৫৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৪৯ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৩০ কিলোক্যালরি। ভিটামিন-এ’র অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫ লাখ শিশু রাতকানায় আক্রান্ত হচ্ছে। একই কারণে প্রতিদিন গড়ে ১০০ এবং বছরে ৩০ হাজার শিশু একেবারেই অন্ধ হয়ে যায়। অথচ ক্যারোটিনসমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি কলমিশাক খেলে এ জাতীয় রোগ হওয়ার আশংকা থাকে না। আমাশয় হলে পাতার রসের সাথে আখের গুড় মিশিয়ে শরবত তৈরি করে সকাল-বিকাল নিয়মিত কয়েক দিন খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। ফোঁড়া হলে আদাসহ কলমিশাকের পাতা সিলপাটায় বেটে এর মাঝখানের অংশ খালি রেখে চারপাশে প্রলেপ দিতে হবে। এভাবে ৩/৪ দিন লেপে দিলে ফোঁড়া গলে পুঁজ বেরিয়ে যাবে। শিশুরা যেন পর্যাপ্ত বুকের দুধ পেতে পারে এজন্য মায়েদের কলমিশাক খাওয়া দরকার। বোলতা, ভিমরুল বা মৌমাছিতে কামড়ালে কিংবা শিং, ট্যাংরা মাছের কাটা ফুটলে কলমিশাকের পাতা ও ডাঁটা বেটে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিলে কিছুক্ষণ পরেই যন্ত্রণা কমে যায়। এছাড়া গনোরিয়া হলে আর সেই সাথে ব্যথা ও পুঁজ জমলে ৪/৫ চা-চামচ কলমিশাকের রসের সাথে পরিমাণমতো ঘি মিশিয়ে সকাল-বিকাল এক সপ্তাহ খেলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে আশা করি। হাত-পা জ্বালা করলে শাকের রসের সাথে সামান্য গরুর দুধ মিশিয়ে সকালে খালি পেটে ১ সপ্তাহ খেলে উপকার পাওয়া যায়। কলমিশাক দেহের হাড় মজবুত করে। চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট তৈরি করে। রক্তশূন্যতা, রাতকানা, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিদ্রা এবং মাথার খুশকি দূরীকরণের পাশাপাশি নারীর ঋতুস্রাবজনিত এবং শরীরবৃত্তিয় সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে বেশ। স্কাার্ভি ও বসন্ত রোগের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। তাই বহু গুণে গুণান্বিত এ শাক আমাদের না খেলেই নয়।

জাত

জলাশয়ে জন্মানো কলমিশাক স্থানীয় জাতের। এর উৎপাদন কম। তাই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৮৩ সালে একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। নাম গিমাকলমি-১। এর ফলন বেশ ভালো।

বপন সময়

গিমাকলমি সারা বছরই চাষ করা যায়। তবে চৈত্র (মধ্য মার্চ-মধ্য এপ্রিল) থেকে শুরু করে শ্রাবণ (মধ্য জুলাই-মধ্য আগস্ট) পর্যন্ত বীজ বপনের উওম সময়।

জমি তৈরি এবং বীজ বপন

প্রথমে ৫-৬ টি চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। লাইন করে এবং ছিটিয়ে উভয় পদ্ধতিতে বীজ বোনা যায়। তবে লাইনে বীজ বপন করলে যত্ন নিতে সহজ হয়। লাইন হতে লাইনের দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার (৮ইঞ্চি) এবং বীজ হতে বীজের দূরত্ব হবে ১৫ সেন্টিমিটার (৬ ইঞ্চি)। এক সাথে অন্তত ২টি বীজ বোনা ভালো। তবে একাধিক চারা জন্মালে ১টি রেখে বাকিগুলো কেটে দিতে হবে। শতাংশপ্রতি বীজ প্রয়োজন হবে প্রায় ৪০-৫০ গ্রাম।

সার ব্যবস্থাপনা

কাক্সিক্ষত ফলন পেতে প্রয়োজন সুষম সার ব্যবহার। মাটির উর্বরতা বিবেচনা করে সার দিতে হয়। এজন্য মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সার দেয়া উওম। আর তা যদি সম্ভব হয় তাহলে স¦াভাবিক মাত্রায় দিতে হবে। শতাংশপ্রতি যে পরিমাণ সার প্রয়োজন তা হলো- ইউরিয়া ৫৬০- ৬৫০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০-৪৯০ গ্রাম, এমওপি ৪০০-৪৯০ গ্রাম এবং জৈব সার ৩২-৪০ কেজি। ইউরিয়া বাদে বাকি জৈব ও অজৈব সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। প্রতিবার পাতা সংগ্রহের পর ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।

আগাছা দমন

অন্য যে কোনো ফসলের ন্যায় কলমিশাকের জমিতে আগাছা জন্মাতে দেয়া যাবে না। কারণ আগাছা খাবারের সাথে ভাগ বসায়। পাশাপাশি রোগ-পোকা আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাই আগাছা দেখা দেয়ার সাথে সাথে তুলে ফেলতে হবে।

সেচ

শুষ্ক মৌসুমে অবশ্যই সেচ দিতে হবে। বর্ষাকালে সাধারণত সেচের দরকার হয় তবে ওই সময় অনাবৃষ্টি হলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

রোগ-পোকা দমন

কলমিশাকে রোগ-পোকা তেমন হয় না বললেই চলে। তবে কিছু পোকার আক্রমণ হতে পারে। যেমনÑ বিটল, বিছা পোকা, ঘোড়া পোকা। এসব পোকা দেখা দিলে হাত দিয়ে ধরে মেরে ফেলতে হবে। তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে দমন করতে হবে। জমি বেশি স্যাঁতসেঁতে থাকলে গোড়া পচে যেতে পারে। ড্যাম্পিং অফ রোগের কারণে এমনটা হয়। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।

শাক সংগ্রহ ও উৎপাদন

বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে শাক সংগ্রহের উপর্যুক্ত হয়। প্রথম সংগ্রহের ৮-১০ দিন পরপর পাতা তোলা যাবে। শতাংশ প্রতি গড় ফলন প্রায় ১৬০-১৮০ কেজি।

বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

দিনের দৈর্ঘ্য কম এবং ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সময় গিমাকলমি ফুল ফোটে। বীজ পরিপক্বের সময় হচ্ছে ফাল্গুন মাস (মধ্য ফেব্রুয়ারি- মধ্যচৈত্র)। গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে এরপর বীজ আলাদা করে নিতে হয়। এরপর হালকা রোদে শুকিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে রেখে মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে। ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ প্রতিরোধে বীজের পাত্রে নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালির শুকনো পাতা দেয়া যেতে পারে।

নাহিদ বিন রফিক
টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট,
কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৫জুলাই২০