দেশের অন্যতম বহুমাত্রিক শিল্পের নাম পোলট্রিশিল্প। কেননা প্রাণিজ আমিষের চাহিদা আর ভিটামিনের ঘাটতি পূরণে পোলট্রির মাংস ও ডিম অনন্য ভূমিকা রাখছে। প্রজন্মের মেধাবিকাশে পোলট্রির ডিম আর মাংসের অবদান আর্থিক বিচারে অতুলনীয়। একই সঙ্গে আত্মকর্মসংস্থান এবং ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এই শিল্পের ভূমিকা জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। পোলট্রিশিল্পে ডিম উৎপাদন, মুরগির বাচ্চা উৎপাদন এবং মাংস উৎপাদনসহ এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফিড ও ওষুধসহ লিঙ্কেজ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়াও পোলট্রির বিষ্ঠা, পায়খনা ও উচ্ছিষ্টাংশও জৈব সারসহ অনেক নতুন শৈল্পিক উপাদান তৈরি হচ্ছে।
এসব মিলিয়ে পোলট্রিশিল্পটি বহুমাত্রিক সম্বাবনাময় শিল্প হিসেবে ডানা মেলতে শুরু করেছে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, পোলট্রিশিল্পের উত্থানকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অপপ্রচার আর গুজবের আতঙ্ক ছড়িয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বারবারই শিল্পের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই করোনাকালে আমাদের পোল্ট্রিশিল্প ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তার ওপর হানা দিচ্ছে গুজব আর অপপ্রচারের কবলে শিল্পের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি। অনলাইন আর সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচার চালানো হয়েছে এই বলে যে পোলট্রির মাংস আর ডিমের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে। প্রথমত, বলা দরকার করোনাভাইরাস যেকোনোভাবেই ছড়াতে পারে। পোলট্রির মুরগি বা ডিম করোনাভাইরাসের বাহক নয়।
আমরা জানি, তৈরি পোশাক খাতের পর দেশে বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছিল এই শিল্পটি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রেখে আসছে পোলট্রিশিল্প। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব শিল্প হচ্ছে পোলট্রি। কারণ এতে সবচেয়ে কম জমির ব্যবহার, সবচেয়ে কম দূষণ, সবচেয়ে কম পানির খরচ, সব ধরনের বর্জ্যই রিসাইকেল হয়। বেকারত্ব, দারিদ্র্যবিমোচন ও পুষ্টির সহজলভ্যতায় পোলট্রির উল্লেখযোগ্য অবদান দিন দিন বাড়লেও স্পর্শকাতর শিল্প হওয়ার কারণে প্রায়ই বড় রকমের ঝুঁকির মোকাবিলা করতে হয় এ শিল্পকে। অতীতে বার্ড ফ্লুর মতো ভয়ানক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খেতে হয়েছে
——শিল্পসংশ্লিষ্টদের। এ ছাড়াও পোলট্রিশিল্পকে জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক মন্দা, উপকরণের উচ্চমূল্য এমনকি রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত। এসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে প্রান্তিক খামারি আর বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তাদের তিল তিল পরিশ্রমের ফলে শিল্পটি খুব দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল। ২০২০-২১ সালে দেশের চাহিদা পূরণ করে রফতানির বড় টার্গেট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিত শিল্পটি কিন্তু এরই মাঝে করোনার ভয়াল থাবা শিল্পের অগ্রযাত্রাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
করোনায় রোগ প্রতিরোধে পোলট্রির মাংস ও ডিম : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষকে বছরে অন্তত ৪৩ দশমিক ৮০ কেজি প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ পোলট্রিশিল্প সমন্বয় কমিটি (বিপিআইসিসি)-এর মতে, বাংলাদেশের মানুষ প্রোটিন গ্রহণ করে গড়ে মাত্র ১৫ দশমিক ২৩ কেজি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গবেষণা মতে, দেশে দৈনিক মুরগির মাংসের ঘাটতি জনপ্রতি প্রায় ২৬ গ্রাম এবং ডিমের ঘাটতি প্রায় ২৩ গ্রাম। ফলে শূন্য থেকে ৫৯ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ খর্বাকৃতির, ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ কম ওজনের এবং ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ ক্ষীণকায় হচ্ছে। অপরদিকে পোলট্রিশিল্প প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। সস্তা এবং সহজলভ্য হওয়ায় পোলট্রির মাংসকে বলা হয় গরিবের পুষ্টির উৎস। আর ডিমকে বলা হয় পাওয়ার অব নিউট্রিশন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, পোলট্রি এমন একটি শিল্প, যার কারণে দেশের জনগণ সুলভে ও সহজে প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারছে। প্রোটিন বা প্রাণিজ আমিষ ভারসাম্য খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ব্রয়লার মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন শরীরের হাড়ক্ষয় প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ব্রয়লারের মাংস কম চর্বিযুক্ত হওয়ায় তা ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাছাড়া ব্রয়লার মুরগির মাংসে ট্রাইফটোফ্যান নামে অ্যামিকো অ্যাসিড থাকে। বিষণœতা বোধ করলে এক বাটি চিকেন স্যুপ এনে দিতে পারে স্বস্তি। যা মানব মস্তিষ্কে সেরেটোনিনের মাত্রা বাড়িয়ে বিষণœতা দূর করে। তাছাড়াও আমাদের শরীরের হেমোকিস্টাইন নামক একটি অ্যামিকো অ্যাসিড থাকে। হেমোকিস্টাইনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্টের বিভিন্ন ধরনের কার্ডিও ভাস্কুলার রোগের বিরুদ্ধে কাজ করতে ব্রয়লার মুরগির মাংস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মাংস ফসফরাস সমৃদ্ধ হওয়ায় কিডনি, লিভার, স্নায়ুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। শরীরে হজম প্রক্রিয়া সহজ করতে ভিটামিন বি-৬-এর ভূমিকা অতুলনীয়। তাছাড়া এই মাংসে নিয়াসিন নামক একটি ভিটামিন থাকে; যাহা শরীরকে ক্যানসারমুক্ত রাখে। অন্যদিকে ডিমের প্রোটিন মাংসপেশি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডিমে বিদ্যমান ভিটামিন-ডি রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং হাড় ও দাঁত শক্ত রাখে। ভিটামিন-এ রাতকানা রোগের ঝুঁকি কমায় এবং ত্বক ও চুলের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ডিমের কলিন গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে। আমেরিকা হার্ট সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিদিন একজন মানুষের ৩০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল প্রয়োজন, যা একটি ডিমে ১৮৬ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল রয়েছে। তাছাড়া ডিমে লুটেইন এবং জিয়াস্যানথিন দুটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে; যা চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। তাই ডিমকে সুপার ফুডও বলা হয়।
সুস্থ জীবনের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ খাবারের খুব প্রয়োজন এড়ানোর সুযোগ নেই। আর শরীরের ভারসাম্য রক্ষাকারী খাবারের মধ্যে অন্যতম প্রোটিন, মিনারেলস, ভিটামিনস, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি। তাই সব সময় সুস্থতার জন্য এবং এই করোনাকালে মুরগির মাংস নিয়ে অভয় দিচ্ছেন ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, এ সময়ে শরীরের দরকার প্রাণিজ প্রোটিন। তারা জোড় দিয়ে বলছেন, সস্তায় প্রোটিন পাওয়ার অন্যতম উৎস মুরগির মাংস ও ডিম। তাই এখন বেশি পরিমাণে প্রোটিনের চাহিদা পূরণে মুরগির মাংস ও ডিম খাওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, মাংস না খেলে প্রোটিনের ঘাটতি হবে। এর ফলে কেবল করোনাভাইরাস নয়, মানবদেহে অন্য যেকোনো ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। করোনাভাইরাসের এই সংকট মুহূর্তে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেশি করে মুরগির মাংস ও ডিম খাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও প্রতিনিয়ত তাদের মতামত দিচ্ছেন। গণমাধ্যমে পোলট্রি মুরগির মাংস ভালোভাবে রান্না করে খাওয়ার ব্যাপারে খবর প্রচার করছে।
ব্রয়লার মুরগি এবং ডিমের মাধ্যমে করোনা ছড়ায় না : পোলট্রির ডিম ও ব্রয়লার মুরগির মাংস নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এ ধরনের অপপ্রচারের কারণে অনেক মানুষ সাময়িকভাবে ডিম ও মুরগির মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে তার নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্যহানির কারণ ঘটছে। তাই এ ধরনের অপপ্রচার বন্ধ হওয়া উচিত। ব্রয়লার মুরগি কিংবা ডিমের মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন গুজবাতঙ্কের বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে দাবি করছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। একই সঙ্গে সংস্থাটি মুরগির মাংস ও ডিম নিয়ে গুজব না ছড়ানোর আহ্বান করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আফ্রিকা চেক, দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া সরাসরি এই গুজবকে নাকচ করে দিয়েছে। তারা জোর দিয়ে বলেছে, ব্রয়লার মুরগি এবং ডিমের মাধ্যমে করোনা ছড়ায় সারা বিশ্বে তার একটিও স্পষ্ট প্রমাণ নেই। বরং করোনার এই ক্রান্তিলগ্নে মুরগির মাংস ও ডিম হতে পারে করোনা মোকাবিলায় রোগ প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার। ডিম ও মাংস হলো মানুষের জন্য উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন আমিষজাতীয় খাদ্য। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের মুরগির ডিম এবং মাংসের গুণাবলি সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন।
করোনাকালে অপপ্রচারে ক্ষতির শিকার পোলট্রিশিল্প : মুরগির মাংস ও ডিম থেকে কোনোভাবে করোনাভাইরাস ছড়ায় না। অথচ করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়েছে পোলট্রিশিল্পে। ক্রেতাদের আতঙ্কের কারণে পোলট্রি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ধসে নেমেছে। প্রথমদিকে মুরগির মাংস ও ডিমের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছেÑ এমন গুজবে মাংস ও ডিম খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। আতঙ্ক এতটাই প্রবল হয়েছিল যে, এক মাসে মুরগির বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছিল। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ থাকায় করোনাভাইরাসের থাবায় বড় ধরনের ধস নেমেছে দেশীয় পোলট্রিশিল্পে। করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে দেশে অনেক ব্রয়লার খামার বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারে ধস নামা আর অনিশ্চয়তার কারণে অনেক খামারি ডিমপাড়া মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। লকডাউনের কারণে হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় কমেছে পোলট্রির মাংস ও ডিমের চাহিদা। এ ছাড়া পরিবহনে সমস্যার কারণে মুরগি ও ডিম পরিবহনে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ফলে লাভ করা তো দূরের কথা মূলধন টেকানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন খামারিরা। উদ্যোক্তাদের দাবি, সামগ্রিকভাবে করোনার প্রভাবে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত পোলট্রিশিল্পে প্রায় ৭ হাজার কোটির টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিনিয়োগকৃত ২৫-৩০ শতাংশ ওয়াকিং ক্যাপিটাল নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ফলে জুলাই মাস নাগাদ এই শিল্পের সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ বেকারত্বের ঝুঁকিতে রয়েছে। আর এ কারণে ৪০ থেকে ৫০ লাখ পারিবারিক নির্ভরশীলের অর্থনৈতি অবস্থা চরম নাজুক পর্যায়ে চলে গেছে। একই কারণে এ শিল্পের সঙ্গে জগিত ২০ লাখ নারীর আর্থসামাজিক অবস্থা চরম ঝুঁকিপূর্ণ।
২০২০-২১ বাজেট পোলট্রিবান্ধব : ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে পোলট্রিবান্ধব হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে পোলট্রিশিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল’ (বিপিআইসিসি)। এ বাজেট ‘কোভিড-১৯’ পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত পোলট্রিশিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংকটকালীন পোলট্রি ও প্রাণিসম্পদবান্ধব বাজেট তৃণমূল খামারিদের মাঝে নতুন করে আশা জাগিয়েছে। সরকারের এ আন্তরিক সহযোগিতা পোলট্রিশিল্পকে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি জোগাবে বলে মন্তব্য করেছেন এ খাতের নেতারা।
লেখক : সাংবাদিক ও সাংবাদিক,
[email protected]
সূত্র: প্রতিদিনের সংবাদ
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৬ফেব্রুয়ারি২০২১