কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালী। আমাদের প্রতিদিনের খাবার তালিকায় মাছ থাকা চাই এ চাই। বাংলাদেশের নদী নালা ও খাল বিলে নানা রকম মাছ পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হল গুলশা মাছ।
গুলশা মাছ বাংলাদেশে চাষকৃত অন্যান্য ছোট মাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। মিঠাপানির এই প্রজাতির মাছটি একসময় বেশি পরিমাণে নদী-নালা, খাল-বিল এবং হাওর-বাওড়ে পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে গুলশা মাছের প্রাপ্যতা পূর্ব অপেক্ষা অনেকাংশে কমে গেছে। বাংলাদেশে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বর্তমানে এই মাছের পোনা উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং স্বল্প পরিসরে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
গুলশা মাছ চাষের সুবিধাঃ
এই মাছ মৌসুমী পুকুর, বার্ষিক পুকুর এবং অন্যান্য জলাশয়ে চাষ করা যাবে।
এই মাছ চাষে পুকুরের সব স্তরের খাবারের ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
৫-৬ মাসের মধ্যেই রুইজাতীয় মাছের পাশাপাশি গুলশা মাছ বাজারজাত করা যাবে।
শুধু রুইজাতীয় মাছ চাষের চেয়ে গুলশা মাছ চাষে অধিক মুনাফা পাওয়া যায়।
গুলশা মাছ সুস্বাদু হওয়ার কারণে এর বাজার মূল্যও বেশি।
চাষ পদ্ধতিঃ
পুকুর প্রস্তুতকরণঃ
শুকনো মৌসুমে পুকুর থেকে জলজ আগাছা পরিষ্কার করে পাড় মেরামত করতে হবে।
ছোট মাছ চাষের বেলায় পুকুর শুকানো উচিত নয়। যার ফলে বার বার ঘন ফাঁসের জাল টেনা দিয়ে রাক্ষুসে মাছ ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণী অপসারণ করতে হবে।
প্রতি শতকে ১-২ কেজি পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। মাটির গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে চুনের মাত্রা কম-বেশি করা যাবে।
পুকুরে মাছের পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মানোর জন্য পোনা ছাড়ার আগেই পরিমাণমতো সার ভালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতকে ৪-৬ কেজি গোবর সার, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
পানির রং সবুজ/বাদামি সবুজ হলে পোনা ছাড়তে হবে।
পুকুরে পোনা মজুদঃ
পুকুরে মাছ চাষের সফলতা সাধারণত নির্ভর করে সুস্থ, সবল ও ভালো প্রজাতির পোনা সঠিক পরিমাণে মজুদের ওপর।
পুকুরে মাছের পোনা ছাড়ার আগে পরিবহনকৃত পোনাগুলো পুকুরের পানির তাপমাত্রার সাথে খাপখাইয়ে নিতে হবে। পরে ১০ লিটার পানি ও ১ চামচ (৫ গ্রাম) পটাসিয়াম পারম্যাংগানেট বা ১০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে নিতে হবে এবং উক্ত দ্রবণে পোনাগুলোকে ১-২ মিনিট গোসল করিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। কার্পজাতীয় মাছের সাথে নিম্নে বর্ণিত ছকের নমুনা অনুযায়ী ১০-১২ সেমি আকারের কার্পজাতীয় মাছ ও ৫-৭ সেমি আকারে গুলশা মাছের সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে।
গুলশা মাছের পরিচর্যাঃ
পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য রাখার জন্য প্রতিদিন বা ৭-১০ দিন পর পর নিয়মিত সার দিতে হবে।
সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দৈনিক শতক প্রতি ১৫০ গ্রাম গোবর অথবা ৩০০ গ্রাম কম্পোস্ট, ৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫ গ্রাম টিএসপি একটি পাত্রে নিয়ে পানির সাথে মিশিয়ে ১ দিন ভিজিয়ে রেখে তারপরের দিন সকালে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
অথবা ৭-১০ দিন অন্তর অন্তর সার প্রয়োগ করতে হলে উপরিউক্ত পরিমাণে দিনের গুণিতক হারে সার দিতে হবে। তবে প্রতিদিন সার ব্যবহার করাই উত্তম। পরিমাণমতো ও নিয়মিত জৈব ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে পুকুরে প্রয়োগ করলে বেশি উৎপাদন পাওয়া যাবে।
পুকুরে সম্পুরক খাদ্য সরবরাহঃ পুকুরে গুলশা ও কার্পের মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে সম্পূরক খাদ্যের উপাদান ও মিশ্রণের শতকরা পরিমাণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
খাদ্য উপাদান মিশ্রণের হার (শতকরা )
চালের মিহি কুড়া ৪০%
গমের ভুসি ২০%
সরিষার খৈল ২০%
ফিশমিল ২০%
মোট ১০০%
১০-১২ ঘণ্টা ভিজানো সরিষার খৈলের সাথে শুকনো গমের ভুসি বা চালের মিহি কুঁড়া মিশিয়ে গোলাকার বল তৈরি করে নিতে হবে। এরপর পুকুরে মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের ৫-৩ % হারে পুকুরে দৈনিক খাবার সরবরাহ করতে হবে। শীতকালে পুকুরে খাবারের পরিমাণ শতকরা ১-২ ভাগ হারে প্রয়োগ করতে হবে। বরাদ্দকৃত খাবার দিনে ২ বার প্রয়োগ করা উত্তম। মাসিক নমুনায়নের মাধ্যমে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করে নিতে হবে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর বাণিজ্যিক পিলেট খাবারও পুকুরে মাছের জন্য সরবরাহ করা যেতে পারে।
দিক নির্দেশনাঃ
পানিতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিলে মাছ পানির ওপর ভেসে ওঠে খাবি খায়। এ অবস্থায় মাছের ফলন কমে। পানিতে সাঁতারকাটা, বাঁশ পানির ওপর পেটানো, দড়ির সাথে লোহা বা মাটির কাঠি বা ইট বেঁধে হররা তৈরি করে পুকুরের তল ঘেষে ধীরে ধীরে টেনে তলার গ্যাস বের করে দেওয়া, পুকুরে পাম্প বসিয়ে ঢেউয়ের সৃষ্টি করা, পানি নাড়াচাড়া করে পুকুরে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
প্রতি মাসে অন্তত একবার কিছু মাছ ধরে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। এছাড়াও পুকুরে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। মাছ চাষের পুকুরে পানি কমে গেলে বাইরে থেকে পানি সরবরাহ করতে হবে। পানি বেশি পরিমাণে সবুজ দেখালে সার প্রয়োগ আপাতত বন্ধ রাখতে হবে।
মাছ আহরণঃ
আংশিক আহরণঃ গুলশা মাছ কার্পজাতীয় মাছের সাথে চাষ করা হয়ে থাকে। কারণ কার্প জাতীয় মাছ ও গুলশা মাছের একই সময়ে বড় হয় না। বেশি লাভের জন্য বড় মাছ আহরণ করে ছোট মাছগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য কার্পজাতীয় যে মাছগুলো ৫০০-৭০০ গ্রামের উপরে হবে তা আহরণ করে পুকুরে সমপরিমাণ পোনা ছাড়তে হবে।
মাছের চূড়ান্ত আহরণঃ বছর শেষে সব মাছ পুকুর থেকে তুলে ফেলতে হবে। বাজার মূল্য ও পোনা প্রাপ্তির ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত মাছ আহরণের সময়কাল ঠিক করে নিতে হবে। গুলশা মাছের বয়স ৮-৯ মাস হলে তা ৪৫-৫০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে যা বাজারে বিক্রির উপযোগী।
মাছ চাষে সম্ভাব্য আয় ব্যয়ঃ
৩০ শতক পরিমাণ পুকুরে গুলশা ও কার্প মাছ চাষের আয়-ব্যয় এবং উৎপাদনের পরিমাণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
মোট ব্যয় = ৪০৫০০ টাকা ।
মোট উৎপাদনের পরিমাণ = ৮০০ কেজি এবং মাছের বিক্রয়মূল্য = ৫৮৫০০.০০ টাকা।
মুনাফাঃ মোট ব্যয় – মোট আয় = ৫৮৫০০.০০ – ৪০৫০০.০০ = ১৮০০০.০০ টাকা।
তথ্যসূত্রঃ এগ্রিকালচার লারনিং
ফার্মসএন্ডফার্মার/২২জুলাই২০