দেশে গবাদিপশু পালনের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে গো-খাদ্য বিশেষ করে কাঁচা ঘাসের সঙ্কট। দেশে ঘাস চাষের জন্য স্বতন্ত্র কোনো জমি নেই। মোট আবাদযোগ্য যে জমি রয়েছে তা সারা বছরই মানুষের খাদ্যের প্রয়োজনে শস্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এর ফলে ঘাস চাষের জন্য কোনো জমি অবশিষ্ট থাকে না।
খাদ্যশস্য উৎপাদনকে মানুষ লাভজনক ভেবেই ঘাস চাষকে গুরুত্ব দেয় না কিন্তু গবাদিপশু খামারী যদি নিজের খামারের গাভীর জন্য ঘাস চাষ করেন তাহলে সেটা লাভজনকই হয়। এটা এভাবে ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। এক বিঘা জমিতে শস্য চাষ করে যে অর্থ উপার্জন করা যায় ঠিক সেই পরিমাণ জমিতেই দুগ্ধবতী গাভীদের জন্য ঘাস চাষ করে দুধ উৎপাদন বাবদ বেশি অর্থ উপার্জন করা সম্ভব।
গবাদিপশুর জন্য বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল ঘাস চাষ করা যায়। উচ্চ ফলনশীল সকল ঘাসেরই পুষ্টিমান উন্নত মানের হয়ে থাকে তবে উৎপাদনের ক্ষেত্রে পার্থক্য হয়ে থাকে। আলফাআলফা এ জাতীয় একটি ঘাস। এ ঘাস সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
আলফাআলফা একটি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের ঘাস। এজন্য এটাকে “পশু খাদ্যের রাণী” হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ঘাস লুছার্ণ নামেও পরিচিত। এটা লিগুমজাতীয় ঘাস এবং একবার চাষ করলে ৪-৫ বছর পর্যন্ত ঘাস সংগ্রহ করা যায়।
কারো কারো মতে আলফালফা বা লুছার্ণ-এর উৎপত্তি পশ্চিম এশিয়ায়। তবে ইরানে প্রথম চাষ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ভারতবর্ষে এ ঘাসের প্রচলন হয় ১৯০০ সালে। এই ঘাস সারা পৃথিবীতেই চাষ করা হয়ে থাকে। তবে আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে সবচেয়ে বেশি আলফালফা উৎপাদিত হয়।
আলফাআলফার গুণাগুণ
আলফালফা ঘাস সরগাম ঘাসে অপেক্ষা প্রায় ৫ গুণ বেশি আমিষ এবং প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন থাকে। দাস ও খুরামা ১৯৬৪ সালে গবেষণা করে দেখেছেন ফুল ফোটার আগে আলফাআলফা ঘাস কাটলে তাতে ৩% আমিষ এবং ১৭.৪% অন্যান্য পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান থাকে। তাছাড়াও এতে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালশিয়াম ও কেরোটিন এবং সামান্য কিছু ফসফরাস থাকে।
জমি নির্বাচন
আলফালফা চাষের জন্য বেলে-দো-আঁশ মাটির চেয়ে কাদা মাটি বেশি গ্রহণযোগ্য তবে জলাবদ্ধ ভূমি ছাড়া সব ধরনের জমিতেই এ ঘাস চাষ করা যায়। এই ঘাস অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না।
বংশ বিস্তার
আলফালফা বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে থাকে।
চাষের সময়
আলফালফা শীতকালের যে কোনো সময় বপন করা যেতে পারে। তবে বপনের উত্তম সময় অক্টোবর হতে জানুয়ারী মাস।
জমি চাষ ও রোপন পদ্ধতি
জমিতে পর্যাপ্ত গোবর সার ছিটিয়ে ২/৩ বার চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। পরে একর প্রতি ৫০-৭০ কেজি সুপার ফসফেট মিশিয়ে দিতে হবে।
আলফালফা বীজ ছিটিয়ে বা সারি করেও রোপন করা যায়। ছিটিয়ে রোপন করলে একর প্রতি ৫-৭ কেজি এবং ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারি করে রোপন করলে ৪-৬ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। এক সাথে ৩/৪টি বীজ গর্তের মধ্যে ১.২৫-২.৫ সেমি গভীরে রোপন করতে হয়।
সার ও পানি সেচ
আলফালফা ডালজাতীয় (লিগুম) ঘাস তাই এরা নাইট্রোজেন সংযোজন ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে বাতাস হতে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে। পানি সেচের পর প্রতি বছর একর প্রতি ৮ কেজি নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করলে লাভজনক ঘাস উৎপন্ন হয়ে থাকে।
ঘাস চাষের জন্য পানির প্রয়োজন হয় যথেষ্ট। জমিতে ঘাস ভালোভাবে না জন্মানো পর্যন্ত প্রায় প্রতি সপ্তাহেই পানি সেচ দিতে হয়। তবে পরবর্তীতে প্রতি ২০ দিন পর সেচ দিলেও চলে।
ঘাসের পরিচর্যা
ঘাসের ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার ও মাটি আলগা করে দিতে হয়। এতে ফলন ভালো পাওয়া যায়।
ঘাস কাটার নিয়ম ও ফলন
২-৩ ইঞ্চি উপর হতে ঘাস কাটতে হয়। এতে অপচয় কম হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ফলনও বেশি হয়। প্রথম বার ফুল ফোটার সময় কাটতে হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ৩৫-৪০ দিন পর পর ঘাস কাটা যেতে পারে। বছরে এই ঘাস ৮/১০ বার কাটা যায়। একর প্রতি প্রায় ২৫-৩০ টন/বছর উৎপাদিত হয়ে থাকে।
ঘাস খাওয়ানোর নিয়ম
এটা যেহেতু লিগুম ঘাস তাই তা নন-লিগুম ঘাসের চেয়ে কম লাগে। কারণ লিগুম ঘাসে আমিষের পরিমাণ বেশি থাকে। একটি গাভীর দৈহিক ওজন ১০০ কেজি হলে এর দৈনিক খাদ্য তালিকায় ০.৭৫ কেজি দানাদার খাদ্য, ১ কেজি শুকনা খড় এবং ৪.০ কেজি কাঁচা আলফালফা ঘাস সরবরাহ করা উচিত। তবে গাভীকে ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় খাওয়ানো হলে ০.৫ কেজি দানাদার খাদ্য, ২.৫ থেকে ৩ কেজি কাঁচা সবুজ আলফালফা ঘাস এবং ২ থেকে ২.২৫ কেজি ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় প্রতিদিন সরবরাহ করা যায়। এই হিসাব অনুযায়ী গাভীর ওজন অনুপাতে প্রয়োজনীয় খাদ্যের মোট নির্ধারণ করে এর অর্ধেক সকালে এবং বাকী অর্ধেক বিকালে খাওয়াতে হবে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি প্রদান করতে হবে।
ঘাস সংরক্ষণ পদ্ধতি
ঘাসে ফল হওয়া শুরুর পূর্বে কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে “হে” আকারে সরবরাহ করা যায়। এজন্য কাটা ঘাস ২-৩ দিন রৌদ্রে ভালোভাবে শুকাতে হয়। শুকানোর সময় বাঁশের আড়া দিয়ে দিনে ৫/৬ বার নাড়া চাড়া করতে হয়। ভালোভাবে শুকানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে ঘাসে যেন ১৪%-এর বেশি আর্দ্রতা না থাকে। এজন্য ঘাস শুকানোর সময় এদিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। ঘাস ঠিকমতো শুকিয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য এক মুঠা ঘাস হাতে নিয়ে চাপ দিলে যদি পুরাপুরি ভেঙ্গে না যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘাস সঠিকভাবে শুকিয়েছে। এই শুকনা ঘাস ঘরে গাদা করে
দীর্ঘদিন রেখে দেয়া যায়।
আলফালফা ঘাস নিয়মিতভাবে গাভীকে খাওয়ানো করা হলে দুধ উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া এতে নন-লিগুম ঘাসের চেয়ে বেশি মাত্রায় আমিষ থাকে বলে আমিষের চাহিদা পূরণেও সহায়তা করে। তাছাড়া আলফালফা ঘাসের শিকড়ে যে “নডিউল” জন্মে তা নাইট্রোজেন (N2) সরবরাহ করে মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৩নভেম্বর২০২০